বরং বাসিন্দাদের ওপরই এই সিদ্ধান্তটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল যে তারা নিজেরাই মুরগিদের জন্য থাকার জায়গা তৈরি করবেন নাকি বাজার থেকে ‘হেনহাউস’ কিনে আনবেন।
প্রকল্প পরিচালনাকারী বিভাগ নিশ্চিত করেছিল, প্রতিটা বাড়িতে মুরগির জন্য পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মানদণ্ড ছিল আনুমানিক আট থেকে ১০ বর্গমিটার জায়গা, যা মুরগি পালনের জন্য যথেষ্ট।
কোলমারে এই প্রকল্প বেশ সাফল্য পেয়েছে এবং এখনো তা চলছে। কোলমার অ্যাগ্লোমেরেশনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরিক স্ট্রুমান বলেছেন, ‘গত কয়েক বছরে অন্যান্য পৌরসভাও এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। ২০২২ সাল থেকে অ্যাগ্লোমেরেশনের ২০টি পৌরসভাই এই প্রকল্পের অংশ।’
এখনো পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের পাঁচ হাজার ২৮২টি মুরগি বিতরণ করা হয়েছে। চলতি বছরের জুন মাসেও মুরগি বিতরণ করা হবে এবং তার জন্য আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছে। এই প্রকল্পের হাত ধরে স্থানীয় বাসিন্দারা যে শুধু পর্যাপ্ত পরিমাণে ডিম পেয়েছেন এমনটাই নয়, খাদ্য বর্জ্য মোকাবেলাও করতে সক্ষম হয়েছেন।
পালন করা মুরগিগুলোকে খাওয়ানোর জন্য তারা ‘কিচেন ওয়েস্ট’ ব্যবহার করেছেন। এই বর্জ্য তাদের কোথাও না কোথাও ফেলতে হতো, তার পরিবর্তে সেগুলো মুরগিদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
স্ট্রুমান ব্যাখ্যা করেছেন, ‘যেহেতু একটি মুরগির গড় আয়ু চার বছর এবং প্রতিদিন তারা ১৫০ গ্রাম জৈব বর্জ্য গ্রহণ করে, তাই হিসাব করে দেখা গিয়েছে (২০১৫ সাল থেকে) ২৭৩.৩৫ টন জৈব-বর্জ্য আমরা এড়াতে পেরেছি।’
প্রসঙ্গত, অন্যান্য বর্জ্য পদার্থের চাইতে খাদ্য বর্জ্য বায়ুমণ্ডলে আরো বেশি পরিমাণে মিথেন নির্গমন করে। যুক্তরাষ্ট্রের হিসাবে বলতে গেলে বর্জ্য পদার্থ থেকে বায়ুমণ্ডলে যে পরিমাণ মিথেন নির্গত হয় তার প্রায় ৫৮ শতাংশই আসে খাদ্য বর্জ্য থেকে। কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে মিথেন বায়ুমণ্ডলে স্বল্পস্থায়ী হলেও বিশ্বের উষ্ণায়নে এর প্রভাব কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়নের দিক থেকে ২০ বছরের সময়সীমায় মিথেনের প্রভাব কার্বন ডাই-অক্সাইডের চাইতে ৮০ গুণ বেশি।
বিশ্বজুড়ে মানুষের জন্য উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অপচয় বা নষ্ট হয়, যার মোট পরিমাণ প্রতিবছর ১৩০ কোটি টন। খাদ্য অপচয় ও খাদ্য বর্জ্যের কারণে বিশ্বজুড়ে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার ৮ থেকে ১০ শতাংশ। এই অঙ্কটা বিমান পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ইন্ডাস্ট্রির কারণে গ্রিনহাউস নির্গমনের প্রায় পাঁচ গুণ।
এদিকে সংক্রমক রোগের উদ্বেগের কারণে যুক্তরাজ্যে মুরগিকে কিচেন স্ক্র্যাপ খাওয়ানোর বিষয়টা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে বিশ্বের অন্যত্র এটা একেবারে আইনসম্মত। এতে খাদ্য বর্জ্যের পরিমাণ যেমন হ্রাস করা যায় তেমনি এমন একটা চক্রের সূচনা করা যায়, যা সব পক্ষের জন্যই উপকারী।
কোলমার একমাত্র শহর নয়, যেখানে বিনা মূল্যে মুরগি বিতরণের এই উদ্যোগ চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি কোলমারেই যে এই প্রকল্প প্রথম শুরু হয়েছিল, এমনটাও নয়। ২০১২ সালে উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আরেকটা ছোট্ট ফরাসি শহর পানসিতে জৈব বর্জ্য কমানোর জন্য এই জাতীয় একটা উদ্যোগ শুরু হয়। সেখানকার প্রতিটা পরিবারকে দুটি করে মুরগি দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় পানসির মেয়র লিডি পাস্টিউ সেখানকার স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘শুরুতে এটা মজার বিষয় ছিল, কিন্তু পরে আমরা বুঝতে পারি যে এই ভাবনাটা বেশ ভালো।’
মোট ৩১টা পরিবারকে মুরগি ও এক ব্যাগ ফিড (মুরগির খাবার) দেওয়া হয়েছিল। এই উদ্যোগের সাফল্য ‘বিস্ময়কর’ ছিল বলেই জানিয়েছিলেন মেয়র লিডি পাস্টিউ।
এ ছাড়া বেলজিয়ামের মুস্ক্রন, অ্যান্টওয়ার্প শহর ও লিম্বাগ প্রদেশে মুরগি বিতরণ করা হয়েছিল। সেখানকার বাসিন্দাদের অবশ্য কমপক্ষে দুই বছর মুরগি না খাওয়ার জন্য একটা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল। শুধু লিম্বাগ প্রদেশে এক বছরে আড়াই হাজারেরও বেশি পরিবারকে পালনের জন্য মুরগি দেওয়া হয়েছিল।
তত্ত্বগত দিক থেকে এই উদ্যোগ বেশ ভালো বলে মনে করা হচ্ছে, বিশেষ করে বিশ্বের এমন কিছু অংশে, যেখানে ডিমের ঘাটতি রয়েছে বা ডিম ব্যয়বহুল। উদাহরণস্বরূপ ক্যালিফোর্নিয়া বা নিউইয়র্কে এক ডজন ডিমের দাম প্রায় ৯ ডলার। কিছু কিছু প্রজাতির মুরগি প্রতিবছর ৩০০টি পর্যন্ত ডিম দিতে পারে। তাই হিসাব কষলে দেখা যাবে একটা মুরগি প্রতি বছর ২২৫ ডলার পর্যন্ত দামের ডিম দিতে পারে।
তবে এই উদ্যোগের এমন একটা উপকার কোলমারে লক্ষ করা গিয়েছিল যা কেউ প্রত্যাশাও করেনি। না, মুরগি পালনের পরিবর্তে ডিমের জোগান বা খাদ্য বর্জ্য মোকাবেলার সঙ্গেও এর কোনো রকম সম্পর্ক ছিল না। এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে বিষয়টা লক্ষ করা গিয়েছিল তা হলো, মুরগি পালনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একাত্মতা। স্থানীয়রা মুরগি পালনের বিষয়ে একে অপরকে সাহায্য করত। কোনো পরিবার ছুটি কাটাতে অন্যত্র গেলে, তাদের পালিত মুরগির যত্ন নেয় প্রতিবেশীরা।
স্ট্রুমানের কথায়, ‘এই উদ্যোগ শুরু হওয়ার সময় থেকেই এখানকার বাসিন্দারা একে স্বাগত জানিয়েছেন। ঠিক সেই কারণেই কোলমারের সব পৌরসভা এখনো এই উদ্যোগে শামিল হয়।’