সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ১৭ জন। তাঁদের প্রত্যেকের কর্মী-সমর্থক রয়েছে। কে কাকে টেক্কা দিয়ে মনোনয়ন নিতে পারবেন সেই প্রতিযোগিতা থেকে স্থানীয় পর্যায়ে চলছে মহড়া। তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব ও প্রবল উত্তেজনা।
দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন
আওয়ামী লীগের তৃণমূলে উত্তেজনা
তৈমুর ফারুক তুষার

শুধু সিরাজগঞ্জ নয়, দেশের অনেক জায়গায় চিত্রই এমন। তৃণমূলের উত্তেজনার ঢেউ এসে পড়ছে কেন্দ্রে। একে অন্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ঘুষ ও চাঁদাবাজির মতো গুরুতর অপকর্মের অভিযোগ করছেন।
এদিকে প্রভাবশালী মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের বিরাগভাজনদের তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সে কারণে আওয়ামী লীগ এবার দলের মনোনয়ন ফরম সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১১ নভেম্বর সারা দেশে ৮৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হবে।
আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য গত শনিবার থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত তিন হাজার ৯৬৫টি মনোনয়ন ফরম বিতরণ করা হয়। আজ বুধবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম উত্তোলন ও জমা দেওয়া যাবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত দলের স্থানীয় সরকার নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সভায় প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ের একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, এরই মধ্যে শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর বিরুদ্ধে নানা গুরুতর অভিযোগ জমা পড়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের মধ্যে আছে ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, জমি দখল, বিএনপি ও জামায়াত পরিবার থেকে আওয়ামী লীগে আসা এবং সরকারি কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক নির্যাতন।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে জমা পড়া অভিযোগের কয়েকটির বিবরণ আওয়ামী লীগের একটি সূত্রে পাওয়া গেছে। ওই সূত্রটি কালের কণ্ঠকে জানায়, বান্দরবানের লামা উপজেলার রূপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী বর্তমান চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মারমা। তাঁর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নানা সংবাদের কপিও যুক্ত করা হয়েছে। ছাচিং প্রু মারমার বিরুদ্ধে ছয়টি অভিযোগ করা হয়েছে। এগুলো হলো—ধর্ষণ, টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জন্ম সনদ বাণিজ্য, ভূমিহীনদের ঘর দিতে ঘুষ নেওয়া, সাংবাদিক নির্যাতন, রাস্তার ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ, সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বিতরণে বাণিজ্য। এর মধ্যে ধর্ষণ ও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে।
ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ফিরোজ খান। তাঁর বিরুদ্ধেও লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। অভিযোগ দেওয়া হয়েছে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমানের কাছেও। লিখিত অভিযোগে ফিরোজ খানকে নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি এবং তিনি রাজাকার পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নবীদুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অপকর্মের অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এসব অভিযোগের সঙ্গে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নবীদুলের চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতির সংবাদের কাটিং যুক্ত করা হয়েছে। সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশীদুল হাসান রশীদের বিরুদ্ধেও রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, সুদের ব্যবসা, দলের ত্যাগী ও পুরনো নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম ও হয়রানির অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার দোয়ারাবাজার ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আবুল মিয়া। আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দেওয়া একটি লিখিত অভিযোগে আবুল মিয়াকে রাজাকারের নাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ তোলা হয়েছে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের দপ্তরে অভিযোগ জমা নেওয়া হচ্ছে। একটি রেজিস্টার খাতাও খুলেছি। সেখানে অভিযোগ আসছে। তৃণমূল থেকে রেজল্যুশন আকারে যে তালিকা পাঠানোর কথা সেখানে কোনো অনিয়ম থাকলে তা মনোনয়ন বোর্ডের সভায় উত্থাপন হবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের এসব বিষয় সুরাহা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁরা বিষয়গুলো দেখছেন।’
কী ধরনের অভিযোগ আসছে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দলের অনেকের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকে। বড় দলে এটা স্বাভাবিক। অনেকেই নানা অপকর্ম, দুর্নীতির অভিযোগ আমাদের জানাচ্ছেন। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। শুধু দলীয়ভাবেই নয়, সরকারের পক্ষ থেকেও নানা মাধ্যমে এসব বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’
প্রভাবশালীদের অপছন্দের কারণে বাদ
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার পূর্ব জুড়ী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হন সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি এর আগেও দুইবার একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু এবার তৃণমূল আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় নাম নেই তাঁর। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর সঙ্গে দূরত্ব থাকায় তাঁকে এই তালিকায় রাখা হয়নি বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকের কাছে আলাদা অভিযোগপত্র পাঠিয়েছেন সালেহ উদ্দিন। সেই অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, যারা নৌকা প্রতীকের বিরোধিতা করেছে, যারা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করেছে তাদের নামও প্রস্তাবিত প্রার্থী তালিকায় রাখা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি আমার জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেক নেতার কাছেই গেছি। কিন্তু কেউই আমার জীবনবৃত্তান্ত গ্রহণ করেননি। কেন করেননি তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিসবাউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা দলের উপজেলা কমিটির কাছে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জীবনবৃত্তান্ত চেয়েছিলাম। কিন্তু সালেহ উদ্দিনের জীবনবৃত্তান্ত আমাদের কাছে পৌঁছেনি। সে জন্য তাঁর নাম তালিকায় নেই।’
জানা গেছে, গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এবং কাপাসিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি এম এ খালেক কাপাসিয়ার টোক ইউনিয়ন পরিষদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকায় তৃণমূলের তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন এম এ খালেক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কাপাসিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আমাকে পছন্দ করেন না। উনার পছন্দের লোক হলেন টোক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ জলিল। এর আগেও এম এ জলিলকে নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি হেরে যান। এবারও তাঁকে মনোনয়ন দেওয়ার লক্ষ্যেই তৃণমূল তালিকা থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
মনোনয়ন ফরম উন্মুক্ত
প্রভাবশালীদের নিজের পছন্দের লোকদের তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় রেখে অপছন্দের লোকদের বাদ দেওয়ার তথ্য আছে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছেও। এ বিষয়টির সুরাহা করতে দ্রুততার সঙ্গে মনোনয়ন ফরম আওয়ামী লীগের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয় দলটি। এর আগে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই ছয়জনের স্বাক্ষরসহ তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় নাম থাকতে হতো। এবারে পরিস্থিতি বুঝে ওই পথে হাঁটেনি আওয়ামী লীগ।
জানতে চাইলে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্থানীয় রাজনীতির জন্য কারো নাম তৃণমূলের তালিকায় না এলেও সমস্যা নেই। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের তালিকা বিশ্লেষণ করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং মনোনয়ন বোর্ড।’
সম্পর্কিত খবর

এসএসএফের সাবেক ডিজি মুজিবুরের ফ্ল্যাট-জমি জব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক

স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী তাসরিন মুজিবের নামে থাকা ফ্ল্যাটসহ ৭৯ শতক জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের নামে থাকা ৩৪টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব হিসাবে এক কোটি ৪৪ লাখ ৯৯ হাজার ২০০ টাকা রয়েছে।
গতকাল রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালত দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদেশ দেন।
জব্দ হওয়া সম্পদের মধ্যে মুজিবুর রহমানের নিজ নামে থাকা মিরপুরের মাটিকাটায় চার হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে থাকা একটি প্লটসহ চার দলিলে খিলক্ষেত, মিরপুর, সাভার ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের জমি এবং স্ত্রীর নামে থাকা ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের সাহারা এলাকায় একটি ফ্ল্যাট, ঢাকার ক্যান্টনমেন্টের বাউনিয়া এলাকায় সাত দলিলে জমি রয়েছে। এ ছাড়া অবরুদ্ধ ব্যাংক হিসাবের মধ্যে মুজিবুর রহমানের ২৪টি ও তাঁর স্ত্রীর ১০টি হিসাব রয়েছে।
এদিন দুদকের উপপরিচালক মো. সিরাজুল হক জব্দ ও অবরুদ্ধ চেয়ে আবেদন করেন।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত মুজিবুর রহমান এসএসএফের মহাপরিচালক ছিলেন।

হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রীর ৬৫ অ্যাকাউন্টে ৭২২ কোটি টাকা লেনদেন
নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৭২২ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ ও তাঁর স্ত্রী নূরান ফাতেমার বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল রবিবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে (ঢাকা-১) মামলা দুটি করা হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রথম মামলায় হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে।
আর দ্বিতীয় মামলায় নূরান ফাতেমা ও তাঁর স্বামী হাছান মাহমুদকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় পরস্পর যোগসাজশে জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ পাঁচ কোটি ৫২ লাখ ৭৬ হাজার ৯০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তা দখলে রাখা এবং ৫৬টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৬৮৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫৪ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারা; দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা দুটি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, তাতে তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এর আগের সরকারে তিনি তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা হাছান মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের সব ধরনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছিল আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

ব্যাংক ও আর্থিক খাত ধ্বংসের হোতা লোটাস কামাল
জয়নাল আবেদীন

পতিত আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল মাত্র পাঁচ বছরে ব্যাংক খাতকে গভীর খাদে নিক্ষেপ করেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়ন, তাঁর সময় ব্যাংকে নিয়ম-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে ব্যাংকঋণ প্রদানের ঘটনা ঘটেছে অহরহ। সেসব ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। যা ছিল মোট ঋণের ১০.৩০ শতাংশ। আর তিনি যখন অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অবসরে যান তখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ গিয়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটিতে।
২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি নিজ দপ্তরে ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল ঘোষণা দিয়েছিলেন, আর এক টাকাও খেলাপি ঋণ বাড়বে না।
সূত্র জানায়, লোটাস কামালের বিরুদ্ধে যাতে ব্যবস্থা না নেওয়া হয় সে জন্য শাসানো হতো তদন্ত কর্মকর্তাদের। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের এক অনুসন্ধানী দলের কর্মকর্তা শাজু এস হোসোইল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘ঘটনা ঠিক কভিডের আগে। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ইন্সপেকশনে গিয়েছিলাম ২০২০ সালের জানুয়ারির ১৯-২০ তারিখের দিকে। সেখানে লোন ক্লাসিফিকেশনের কনসোলিডেটেড সিএলের এক্সেল শিটে ফিল্টার করে দেখি অবজেক্টিভ ক্রাইটেরিয়ায় ক্লাসিফায়েড হওয়া লোন আন-ক্লাসিফায়েড বানানো হয়েছে। প্রায় ১.৫-২ হাজার কোটি টাকার এই লিস্টে অনেক কম্পানির নাম। এই লিস্টের একটা কম্পানি ছিল ‘লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং’, যার অফিশিয়াল মালিক তখনকার অর্থমন্ত্রী লোটাস কামালের মেয়ে ও স্ত্রী। ঋণের বকেয়া ১.৭৫ কোটি টাকা, আর কিস্তি মাত্র ১৮ লাখ টাকার মতো। মাত্র ১৮ লাখের কিস্তি, তা-ও তিনি নিয়মিত পরিশোধ করেন না বলে সেটা সাব-স্ট্যান্ডার্ড বা অন্তত তিন মাস (অথবা ৯ মাস পরের সার্কুলার অনুযায়ী, মনে নেই) ধরে বকেয়া ছিল। মেমো দেওয়ার পর সোনালীর লোকজন অনেক হম্বিতম্বি করেছে, সময়ক্ষেপণ করেছে জবাব দেওয়ার। টিম লিডার বহলুল স্যারকেসহ আমাদের চেম্বারে ডেকে তখনকার এমডি ধমকের সুরে বলেছিলেন, ‘এই বহলুল, এগুলা কি শুরু করলেন।’
তিনি আরো লেখেন, ‘কামাল সাহেবকে এর পরে খেলাপি ঋণ নিয়ে মিডিয়াতে বড় বড় কথা বলতে দেখতাম। এমনকি খেলাপি আর এক টাকাও বাড়বে না এমন বক্তব্যও দিতে শুনতাম। ওই সময়টায় আমি বলতাম, যে দেশের অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের টাকা দেন না, সে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার কথা সত্যি হতে বেশি সময় নেয়নি। পালানোর তালিকায় উনার নাম সবার আগে দেখলাম। কেন? আপনারা এখন জানেন।’
শেয়ারবাজার কারসাজি : ২০১০ সালে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনায় লোটাস কামালের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে। তিনি তখন অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন। নানা অভিযোগ থাকার পরও শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কোনো ধরনের শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি লোটাস কামালকে। অনেকের অভিযোগ, তাঁর সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাজারের লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। লোপাট করে নেওয়া হয়েছে তাঁদের পুঁজি।
২০১০ সালের শেয়ারবাজার কারসাজিতে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালের পকেটে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা গেছে বলে বিভিন্ন তদন্তে জানা যায়। শেয়ার জালিয়াতি করে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ সালের ওই কেলেঙ্কারির পর কৃষি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
ব্যাংক হিসাব জব্দের আগেই সরানো হয় টাকা : গত ২২ আগস্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল, তাঁর স্ত্রী কাশমেরী কামাল ও মেয়ে নাফিসা কামালের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। একই সঙ্গে তাঁদের মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন স্থগিত করা হয়। সূত্রের দাবি, দেশে-বিদেশে মুস্তফা কামাল ও তাঁর স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। সরকার পতনের আগেই কামাল ব্যাংক, রাজধানীর বাসা-অফিস থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার সরিয়ে নিয়েছেন।
লোটাস কামালের বর্তমান দায় : জানা যায়, এখনো সোনালী, পদ্মা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকে দায়-দেনা পরিশোধ বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। দেনা পরিশোধ না করার পরও তাঁকে খেলাপি দেখাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসের এখনো লোটাস ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাঁচ হাজার ১৯৩ টাকা পাওনা রয়েছে। কিন্তু এই তথ্য মানতে নারাজ সোনালী ব্যাংক লোকাল অফিস। ব্যাংক জানায়, ঋণ পরিশোধ হয়ে গেছে।
প্রিমিয়ার ব্যাংকের বনানী শাখায় এখনো ৯৯ লাখ টাকার এলসি বকেয়া রয়েছে মুস্তফা কামালের। ২০২৩ সালের ২১ অক্টোবর এলসি পরিশোধের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত ঋণটি বকেয়া রয়েছে। পদ্মা ব্যাংকে পর পর দুটি এলসি করে কোনো টাকা পরিশোধ করেননি সাবেক এই অর্থমন্ত্রী। প্রথম এলসিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৬ সালের ৮ মার্চ। যেখানে বকেয়ার পরিমাণ চার কোটি ৫০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় এলসি পরিশোধের শেষ তারিখ ছিল ২০২০ সালের ৯ এপ্রিল। এখানেও চার কোটি ৫০ লাখ টাকা বকেয়া রেখেছেন কামাল। বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য চলতি দায়িত্বে থাকা পদ্মা ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কাজী মো. তালহা জানান, তাঁদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা ছিল অনেক আগে। এখন কোনো ব্যবসাও নেই, আর বকেয়াও নেই। হয়তো কোথাও কোনো তথ্যগত ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।