<p>সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে প্রতিদিনের খবরের কাগজে বিচারব্যবস্থা সংস্কার অসংখ্য মানুষের আলোচনা-সমালোচনা ও আকাঙ্ক্ষার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঙ্ক্ষিত এই সংস্কার কি শুধু প্রক্রিয়ার সংস্কারে অর্জন সম্ভব, নাকি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও সংস্কার প্রয়োজন?</p> <p><img alt="নিষ্কণ্টক স্বাধীন বিচারব্যবস্থা চাই" height="655" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif2/13-01-2024-p14-5.jpg" style="float:left" width="300" />প্রথমে আমরা এটা মেনে নিই যে বিচারব্যবস্থায় আস্থাহীনতা এই অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। অবিভক্ত ভারতবর্ষে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই বিচারব্যবস্থার সূচনা হলেও তৎকালীন বিচারব্যবস্থা গভীরভাবে সামাজিক শ্রেণি প্রথা দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং বিচারকার্য রাজতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত ছিল। ন্যায়বিচারের আলোকবর্তিকার প্রভাব তখনো নিষ্কণ্টকভাবে সমাজে প্রতিফলিত হয়নি। ঐতিহাসিক সময় ও শাসনকালের পরিক্রমায় বিচারিক ব্যবস্থা হিন্দু আমল, মুসলমান আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল পার করেছে এবং সর্বশেষ স্বাধীন বাংলাদেশ তার স্বতন্ত্র বিচারব্যবস্থার অধিকার লাভ করেছে ঠিকই; কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দৃঢ় বিচারব্যবস্থা ও সামাজিক ন্যায়বিচার যেন এখনো আপামর জনতার স্বপ্ন।</p> <p>সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের সংকীর্ণ মনোভাব অনেকাংশে আমাদের জাতীয় বিচারব্যবস্থায় ফাটল ধরিয়েছে। এই ফাটল নিরাময়ে নতুন বছরে যেমন সুদৃঢ় বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিতে হবে, তেমনি সমান্তরালে সামাজিক ন্যায়বিচারও সুপ্রতিষ্ঠা করার নব উদ্যোগ নিতে হবে।</p> <p>সহজ কথায়, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মূল স্লোগান হলো বৈষম্য দূরীকরণ—তা সে যেভাবেই হোক। জাতিগতভাবে আমরা বিভিন্ন সামাজিক স্তরে ও বিষয়ে সাম্যের মান এখনো নিশ্চিত করতে পারছি না, যা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশের অন্তরায়। যেমন ধরুন, পুরুষের তুলনায় নারীর অবস্থান নিম্নে—এ রকম একটি সেকেলে ধারণা বদলাতে আজও আমাদের বেগ পেতে হয়, বিতর্ক হয়; অথচ আমরা আপামর জনতা নির্দ্বিধায় কথায় কথায় পক্ষপাতহীন ও স্বাধীন বিচারব্যবস্থা চাই। আমাদের কর্ম এবং আমাদের চাওয়া কি পরস্পরবিরোধী নয়?</p> <p>এটি এখন স্পষ্ট যে আমাদের জাতিগত দীর্ঘমেয়াদি উন্নতিতে সামাজিক ন্যায়বিচারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ বাদ দিয়ে টেকসই বিচারব্যবস্থা প্রণয়ন অবাস্তব। আজকের চলমান সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং বিচারিক অনাস্থার ক্ষেত্রে আমাদের ক্রমবর্ধমান অসাম্য আচরণ জাতীয় মনোযোগের দাবি রাখে এবং অচিরেই সামাজিক ন্যায়বিচারের স্থাপত্যের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিন্যাস না করলে এই সমাজ ‘ডুম লুপ’-এর দুষ্টচক্রে পড়ে স্থবির অসাম্য নীতিসম্পন্ন জাতিতে পরিণত হবে। লিঙ্গ, বয়স, বর্ণ, ধর্ম, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যহীন চেতনা গড়ে তুলতে হবে; আমাদের একই সঙ্গে সব স্তরের কাজের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সমাজে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে, জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পাবে এবং সর্বোপরি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ইকোসিস্টেম তৈরি হবে, যা আমাদের জাতিগত বন্ধনের জন্য এখন অত্যাবশ্যক।</p> <p>বিচারব্যবস্থা বলতে শুধু আদালত পরিচালনার প্রক্রিয়াকে বোঝায় না, বিচারব্যবস্থা একটা মাইন্ডসেট। বিচারব্যবস্থাকে দৃঢ় করতে হলে সবাইকে বিচারব্যবস্থাকে সম্মান করার ও স্বাধীন করার মাইন্ডসেট তৈরি করতে হবে, প্রয়োজন হবে জনগণ ও বিচারব্যবস্থার কোয়ালিশন। সামাজিকভাবেই অবিচারকে রুখে দাঁড়াতে হবে, অসাধু স্বার্থের জন্য বিচারব্যবস্থা ব্যবহার করা যাবে না। সে জন্য নিজেদেরই প্রথমে বিচারব্যবস্থার একজন অংশীদার মেনে সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া অবিচারগুলো রুখতে হবে। দ্বিতীয়ত, সত্যিকারের বিচারিক সিস্টেম তৈরিতে লাগবে যোগ্য বিচারকদের মনোনয়ন। আমাদের দেশে শুধু সরকারি পরীক্ষা পাস করা ম্যাজিস্ট্রেট বিচারিক অভিজ্ঞতাহীন অবস্থায় বিচারকের অবস্থানে বসে বিচারের ভাগ্য নির্ধারণ করছেন। আমরা এমন বিচারব্যবস্থা চাই, যেখানে বিচারক থাকবেন অভিজ্ঞ, সৎ ও বিচারিক মাইন্ডসেটসম্পন্ন এবং যাঁর ওপর একজন বিচারপ্রার্থী আদালতে তাঁর শেষ আস্থাটুকু রাখতে পারেন। সেই লক্ষ্যে নিম্ন ও উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের নতুন নীতিমালা ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে এবং সময়ে সময়ে বিচারকদের বিচারের মান পরীক্ষণের ভিত্তিতে তাঁদের পদোন্নতিনীতি তৈরি করতে হবে।</p> <p>তৃতীয়ত, ব্রিটিশ আমল থেকে বয়ে চলা শাসন বিভাগের কর্তৃত্ব বিচার বিভাগ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরিয়ে নিতে হবে। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইনসভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা এখন সবচেয়ে জরুরি। কেননা শাসকের আইন নয়, বরং আইনের শাসন নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের সর্বপ্রথম দায়িত্ব। ভারতবর্ষে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক্করণের সর্বপ্রথম ধারণা দেন লর্ড কর্নওয়ালিস, ১৭৯৩ সালে। প্রস্তাব করেন নির্বাহী ও বিচার বিভাগকে আলাদা করার, যা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে অনুমোদিত হয়নি। বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত ‘মাসদার হোসেন মামলা’ বাংলাদেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন করার এক যুগান্তকারী মাইলফলক রায় নিয়ে এসেছিল। বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথকও করা হয়েছিল ২০০৭ সালে। তবে কার্যত বাস্তবতা ভিন্ন; সেই মামলার বাদী সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন কিছুদিন আগেও এক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের বাস্তবায়ন হলে আমাকে এত কথা বলতে হতো না।’ তার মানে হচ্ছে, আমরা এখনো স্বাধীন বিচারব্যবস্থা বুঝে পাইনি। বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের স্বার্থে মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন একান্ত আবশ্যক। তবে একই সঙ্গে বিচারকদেরও জবাবদিহির নিয়মতান্ত্রিক জায়গায় আনতে হবে, যেন বিচারকরা স্বৈরতন্ত্র চর্চা করতে না পারেন।</p> <p>বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে আইনজীবীদের গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের উচিত আইনজীবীদের মান ও ইথিক্স নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন করে আইনজীবীদের কাজের মানের ওপর প্রতিবছর প্রতিবেদন তৈরি করা, আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাহলে আইনজীবী, বিচারক ও বিচারপ্রার্থীর মধ্যে চেক অ্যান্ড ব্যালান্স নির্ণয় হবে।</p> <p>গত ৩ অক্টোবর ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টার অনুমোদনক্রমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। আমি মনে করি, একটি প্রগতিশীল বিচারব্যবস্থার জন্য আমাদের একটি স্বাধীন ও স্থায়ী বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন দরকার, যারা সময়ে সময়ে বিচারব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করার প্রস্তাব দেবে, বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও অস্বচ্ছতা তুলে ধরবে, বিচারপ্রার্থীর সুবিধা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় লিগ্যাল এইড ও আইনজীবীদের পারফরম্যান্স তুলে ধরবে এবং বিচার বিভাগকেও জবাবদিহির আওতায় আনবে, যাতে দেশের জনগণ বিচারব্যবস্থার ওপর বলিষ্ঠ আস্থা আনতে পারে।</p> <p>বিচারব্যবস্থা সংস্কার একটি বিস্তর বিষয়, তবে আমরা বিশ্বাস করি, জনসাধারণের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের সঠিক মনোভাব তৈরি হলে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলে নির্ভরযোগ্য বিচার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যেন বিচারপ্রার্থীদের শেষ ভরসার জায়গা অন্তত আদালত প্রাঙ্গণ হয়। আমরা খুবই আশাবাদী, কেননা নতুন তরুণসমাজ আজকে সচেতন, শিক্ষিত এবং সাম্যবাদী অধিকার নিশ্চিতে উদ্যমী। তাই রাষ্ট্রের সব কার্যনির্বাহী ও নীতিনির্ধারকসহ সব স্তরের মানুষের কাছে একটি শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা বিনির্মাণে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের আশাবাদ ব্যক্ত করছি।</p>