<p><span style="color:#c0392b">যশোরে দেশের সবচেয়ে পুরনো সূর্যঘড়ির অবস্থান থাকলেও এটা দৃষ্টিকটু অবহেলার শিকার।  ঐতিহাসিক প্রত্ননিদর্শনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়াও কষ্টকর। প্রত্ন-ঐতিহ্য বিবেচনায় এটির যথাযথ সংরক্ষণ যশোরবাসীর প্রাণের দাবি</span></p> <p> </p> <p>সূর্যঘড়ি। ইংরেজিতে সানডায়াল। এই ঘড়িতে ব্যাটারি নেই। নেই দম দেওয়ার প্রয়োজন। ফলে বর্তমান যুগের যান্ত্রিক ঘড়ির মতো কোনো শব্দও নেই। সূর্যঘড়ি প্রকৃতিনির্ভর সময় দেখার প্রাচীন মাধ্যম। এটি সূর্যের অবস্থান আর মাটিতে ছায়া ব্যবহার করে সময় নির্ধারণ করার কৌশল। প্রাচীনকাল থেকেই সূর্যঘড়ি ব্যবহার করছে মানুষ। যখন ঘড়ি আবিষ্কৃত হয়নি, তখন মানুষ সময়ের হিসাব রাখত সূর্যঘড়ি ব্যবহার করে। এই ঘড়ি রাতের বেলা কাজ করে না; দিনের বেলা সূর্যের আলোয় কাজ করে। এই ঘড়ি আবার সব সময় সঠিক সময় দেয় না। কারণ বিভিন্ন ঋতুতে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তিত হয়।</p> <p>আমাদের দেশেও রয়েছে সূর্যঘড়ি। বলধা গার্ডেনের সূর্যঘড়িকে দেশের সবচেয়ে পুরনো দাবি করা হয়। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে। বলধার জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে বলধা গার্ডেনের ঘড়ির চেয়েও ১১৬ বছরের পুরনো সূর্যঘড়ি রয়েছে অবিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা যশোরে। এর অবস্থান যশোর শহরের বর্তমান জেলা রেজিস্ট্রি অফিসে, যেটি ছিল দেশের প্রথম কালেক্টরেট ভবন।</p> <p><img alt="অন্ধকারে পুরনো সূর্যঘড়ি" height="477" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/03-12-2024/8888.jpg" style="float:left" width="351" />ব্রিটিশদের প্রশাসনিক কাজে সুবিধার জন্য ভবনটি নির্মাণ করা হয় ১৭৯৩ সালে। সে সময় যশোরের কালেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন মিস্টার রোক। যশোরের প্রথম কালেক্টর মিস্টার টিলম্যান হেংকেলের সহকারী ছিলেন মিস্টার রোক। যশোরে ১৮৬৮ থেকে ১৮৭২ সাল পর্যন্ত কালেক্টরেট পদে দায়িত্ব পালন করা জেমস ওয়েস্টল্যান্ড রচিত ১৮৭১ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘এ রিপোর্ট অন দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব যশোর’ বই থেকে এ তথ্য জানা যায়। সে আমলেই প্রশাসনিক কাজে সময় নির্ণয়ের জন্য তৎকালীন কালেক্টরেট ভবন প্রাঙ্গণে সূর্যঘড়িটি নির্মাণ করা হয়।</p> <p>তবে বর্তমানে রেজিস্ট্রি অফিসের জায়গায় ঐতিহাসিক নিদর্শনটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। এমনকি যশোর শহরের বেশির ভাগ মানুষই জানে না তাদের জেলায় সূর্যঘড়ি রয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, রেজিস্ট্রি অফিসের পশ্চিম পাশে দলিল লেখকদের শেড। সেই শেডের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে চারপাশ টিন দিয়ে ঘিরে করা হয়েছে একটি ঘর। ঘরটি সামান্য অংশ ফাঁকা রেখে মাঝখানে টিনের বেড়া দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছে দুই অংশে। বিভক্ত অংশের এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাওয়া-আসার জন্য সামান্য ফাঁকা রাখা হয়েছে। ঘরটির দুই অংশেই সারি সারি কম্পিউটার প্রিন্টার। সেখানে দলিল লেখকদের কাজ চলছে। জানা না থাকলে দেখে বোঝার উপায় নেই সূর্যঘড়িটি ঘিরে নিয়ে কক্ষটি নির্মাণ করা। পুরো কক্ষটিই আসলে সূর্যঘড়ির অংশের ওপর নির্মিত।</p> <p>কক্ষটিতে ঢুকতেই দেখা গেল, সূর্যঘড়ির এক অংশের ওপর কাগজপত্র রেখে দাঁড়িয়ে একজন কী যেন লিখছেন। যেন সেটি একটি লেখার টেবিল! ঘড়িটির অন্য প্রান্তের অংশে লাগানো ছিল একটি ফলক। তবে এখন সেই ফলক নেই। কোনোকালে হয়তো খুঁড়ে তুলে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে বোঝা গেল, নানা অত্যাচার চলেছে তার ওপর। সূর্যঘড়িটি সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত বহু বছর। এখন যেন তার অপেক্ষা অবিবেচক মানুষদের লোভের অত্যাচারে অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার।</p> <p>এ বিষয়ে কথা হয় যশোর দলিল লেখক কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি হায়দার আলীর সঙ্গে। প্রবীণ হায়দার ১৯৭৪ সাল থেকে যশোর রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক পেশায় নিয়োজিত। বললেন, ‘দীর্ঘ বছর ধরে এটি এখানেই আছে। এটি সূর্যঘড়ি। ব্রিটিশ আমলে এটি নির্মিত বলে শুনেছি।’ ঐতিহাসিক নিদর্শনটি এভাবে টিন দিয়ে ঘিরে নেওয়া কি ঠিক হয়েছে? এমন প্রশ্নে তিনি কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি।</p> <p>এ ব্যাপারে যশোর এম এম কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক শামীমা আখতার বলেন, ‘যশোর জেলার আছে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ব্রিটিশ সরকারের আমলে অবিভক্ত বাংলার সর্বপ্রথম কালেক্টরেট ভবন নির্মাণ করা হয় এখানে, যেখানে সূর্যঘড়ি স্থাপন করা হয়। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে সেখানে রেজিস্ট্রি অফিসের কার্যক্রম চলমান থাকায় সাধারণ মানুষ দুর্লভ ঘড়িটি দেখার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণের পরিপন্থী। সুতরাং দাবি থাকবে, সাধারণ মানুষের জন্য সূর্যঘড়িটি সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত রেখে এবং যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে যশোরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা করা হোক।’</p> <p>এ বিষয়ে যশোরের জেলা রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ আবু তালেব সূর্যঘড়িটি টিনশেড করে দলিল লেখকদের ঘিরে রাখার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এখানে একটি সূর্যঘড়ি আছে, এটা আমি এখানে এসে শুনেছি। প্রাচীন নিদর্শন হওয়ায় আমি আগ্রহ করে দেখতে গেছি। কিন্তু দলিল লেখকদের শেড এখানে এমনভাবে তৈরি করা যে সেখানে যাওয়া যাচ্ছে না। এটা অনেক পুরনো। তবে আগেও কেউ এটা সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আমরা চেষ্টা করছি সূর্যঘড়িটি যথাযথ সংরক্ষণের।’</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>