এ জন্য কিডনি রোগকে বলা হয় ডিজিজ মাল্টিপ্লাইয়ার। যেমন স্বল্প মাত্রায়ও সিকেডি থাকলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে, তেমনি আরো অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তৃতীয়ত, কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে তার চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে আমাদের মতো দেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকও তা বহন করতে পারে না। ফলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কিডনি বিকল রোগী অকালমৃত্যু বরণ করে। চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবার দেউলিয়া হয়ে যায়।
আশার আলো এই যে কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১০ শতাংশ লোক চিকিৎসা নিতে হিমশিম খায়, সেখানে একটু সচেতন হলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়।
প্রতিরোধের প্রধান দুটি উপায়
প্রথমত, প্রাথমিক অবস্থায় সুপ্ত কিডনি রোগ নির্ণয় করে তা চিকিৎসা করা। যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে, তাদের মাত্র দুটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ নির্ণয় করা যায়—একটি প্রস্রাবে প্রোটিন যায় কি না; অন্যটি রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে কিডনি শতভাগের কত ভাগ কাজ করছে, তা নির্ণয় করা যায়। এই দুটি পরীক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালেও করা যেতে পারে।
কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে কারা?
যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বংশে কিডনি রোগ আছে, ধূমপায়ী, মাদকসেবী, অতিরিক্ত ওজন, বেশিদিন ব্যথার বড়ি খেয়েছে, বারবার কিডনিতে পাথর বা মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয়। শিশুকালে কিডনি রোগ থাকলে। এমনকি বয়স ৫০-এর ওপরে গেলে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের বছরে অন্তত দুইবার কিডনি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।
সুস্থ জীবনধারা
কিডনি ভালো রাখতে সুস্থ জীবনধারা চর্চা অপরিহার্য। আটটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়মিত মেনে চললে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ১. নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম। ২. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। ৩. সুষম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ। ৪. পর্যাপ্ত পানি পান। ৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ। ৬. ধূমপান ও মাদক পরিহার। ৭. ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন। ৮. নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা।
কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রধান চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা
১. সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। কিডনি রোগের ঝুঁকি, লক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল ধারণা। ২. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। অনেক অঞ্চলে কিডনি রোগ নির্ণয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। ৩. আর্থিক সীমাবদ্ধতা—ডায়ালিসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যয় অনেক বেশি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা বা বাজেটের অভাব। ৪. কিডনি বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা। জাপানে প্রতি মিলিয়ন লোকের জন্য ৩৪ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ, পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আছে দুজনেরও কম। অন্যদিকে সাধারণ চিকিৎসকরা কিডনি সম্পর্কে কম সচেতন। ৫. অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও ঝুঁকির কারণ বৃদ্ধি। যেমন—ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ক্রমাগত বাড়ছে; অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের অভাবে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ৬. সাংস্কৃতিক ও কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ, হারবাল চর্চা করতে গিয়ে বিলম্বে রোগ নির্ণয়ও কিডনি বিকলের ঝুঁকি বাড়ে।
প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের উপায়
নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নীতিনির্ধারকদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন—ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং প্রগ্রাম চালু করা। সুলভ মূল্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা।
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সাধারণত চিকিৎসকদের কিডনি রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কমিউনিটি আউটরিচ প্রগ্রাম ও বিনা মূল্যে স্ক্রিনিং ক্যাম্পের আয়োজন করতে হবে। গণমাধ্যমের সহায়তায় কিডনি স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রচার করতে হবে।
চিকিৎসার ব্যয় কমানো ও সহায়তা প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখতে পারে। কিডনি রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যেতে পারে। কিডনি রোগীদের জন্য মাইক্রোফিন্যান্স বা স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাশ্রয়ী কিডনি চিকিৎসা গবেষণা ও উদ্ভাবনে সহায়তা করতে হবে।
আসুন, কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবাই মিলে একযোগে কাজ করি এবং সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করি।
লেখক : সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) এবং অধ্যাপক, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল