<p>১৯৭৪ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ স্টিফেন হকিং একটি চমকপ্রদ ধারণা উপস্থাপন করেন। তিনি দেখান যে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুসারে, ব্ল্যাকহোল থেকেও কণা নির্গত হতে পারে। তার মতে, এই কণা নির্গমনের ফলে ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে শক্তি ও ভর হারিয়ে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত হয়ে যায় এবং সম্ভবত একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেষ হয়। এখানে বাষ্পিভূত হওয়া বলতে আসে ধীরে ধীরে শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া বোঝায়—গ্যাসে পরিণত হওয়া বোঝায় না।</p> <p>ব্ল্যাক হোল কীভাবে কাজ করে?</p> <p>আলবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, ব্ল্যাক হোল হলো এমন এক বস্তু যার ভর এতটাই বেশি এবং মহাকর্ষ এতটাই শক্তিশালী যে কোনো কিছুকেই এটি থেকে বের হতে দেয় না, এমনকি আলোও নয়। ব্ল্যাক হোলের ‘ইভেন্ট হরাইজন’ বা ঘটনার সীমারেখার ভেতরে প্রবেশ করলে কোনো কিছুরই আর ফিরে আসার পথ থাকে না।</p> <p>কিন্তু হকিং দেখিয়েছিলেন, ব্ল্যাক হোলের এই নিয়ম কিছুটা ভাঙতে পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী, শূন্যস্থান কখনোই পুরোপুরি শূন্য নয়। সেখানে সব সময়ই কণা ও অ্যান্টি-কণার জোড়া তৈরি হয় এবং ধ্বংস হয়। তবে, ইভেন্ট হরাইজনের কাছে তৈরি হওয়া জোড়ার একটি কণা ব্ল্যাক হোলের ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। আর অন্যটি মহাশূন্যে পালিয়ে যেতে পারে। পালিয়ে যাওয়া এই কণাগুলোকে উজ্জ্বল হয়ে বিকিরণ নিঃসরণ করে। এই বিকিরণকে বলা হয় হকিং রেডিয়েশন বা হকিং বিকিরণ।</p> <p>হকিং রেডিয়েশনের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে শক্তি ও ভর হারায়। এটি অত্যন্ত ধীর একটি প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যের ভরের সমান একটি ব্ল্যাক হোল সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত হতে 10<span style="font-size:10px"><sup>67</sup></span> (একের পিঠে ৬৭টা শূন্য) বছর সময় নেবে। এটা মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সের চেয়েও অনেক বেশি।</p> <p>ব্ল্যাকহোলের বাষ্পীভব প্রক্রিয়াটা একটি বড় বিভ্রান্তি তৈরি করে দেয়। সেটাকে বলা হয় ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স। এই প্যারাডক্সের মূল বক্তব্য হলো— বাষ্পিভূত হওয়া মানে সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়া। ব্ল্যাকহোল যদি শূন্যে সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়, এর ভেতরকার তথ্যগুলো কি তবে হারিয়ে যায়?</p> <p>এখানে তথ্য বলতে একটা ব্ল্যাকহোল তার সারাজীবনে যত বস্তু, বিকিরণ ইত্যাদি গিলে খেয়েছে, সেগুলো পরিমাণগত তথ্য বোঝানো হয়েছে। যেমন, ভর, চার্জ, স্পিন ইত্যাদি।</p> <p>তাপগতিবিদ্যার সূত্র অর্থাৎ শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্রানুযায়ী মহাবিশ্বের কোনো তথ্য সম্পূর্ণরূপে বিলোপ হওয়ার সুযোগ নেয়। বরং তথ্য এক রূপ থেকে আরেক রূপে রূপান্তরিত হতে পারে। হকিং ব্ল্যাকহোলের বাষ্পিভূত হওয়ার তত্ত্বানুযায়ী তথ্য শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে। এটা তাপগতিবিদ্যার সূত্রের পরিপন্থি। মহাবিশ্বে আজ পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি বা এমন কোনো সূত্র বা বস্তু পাওয়া যায়নি, যা শক্তির সংরক্ষণশীলতার সূত্রকে অমান্য করে। তাহলে ব্ল্যাকহোলে এমনটা কেন ঘটছে?</p> <p>এই ব্যাপরটাকেই বলা হচ্ছে ব্ল্যাকহোল ইনফরমেশন প্যারাডক্স। </p> <p>বিজ্ঞানীরা এখনো এই প্যারাডক্স সমাধানের চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের এম আইটির বিজ্ঞানী প্যাট্রিক হারলো হারলো বলেন, ‘হকিংয়ের প্যারাডক্সের বিস্ময়কর বিষয় হলো, এটা সমাধান করতে হলে পদার্থবিজ্ঞানের এক মৌলিক নীতি ত্যাগ করতে হবে।’ ১৯৭৬ সালের একটি গবেষণাপত্রে হকিং এই সমস্যার সমাধান হিসেবে প্রেডিক্টাবিলিটির ধারণাটা ত্যাগ করেছিলেন।</p> <p>কিছু বিজ্ঞানী থার্মোডাইনামিকসের নিয়ম এবং কীভাবে এনট্রপি কোয়ান্টাম তথ্যকে প্রভাবিত করে তা পরীক্ষা করে দেখছেন। অন্য একটি দল লোকালিটি  বা স্থানীয়তার নীতি) নিয়ে কাজ করছে। এই পরীক্ষা বলছে,  যে কোনো বস্তু কেবল তার কাছাকাছি থাকা বস্তুর দ্বারা প্রভাবিত হয়। তারা মনে করেন, ‘কোয়ান্টাম নন-লোকালিটি’নামের ধারণার মাধ্যমে এই প্যারাডক্স সমাধান করা সম্ভব।</p> <p>এই ধারণা অনুসারে, ব্ল্যাক হোলের ভেতরের কণাগুলো তাদের বাইরের সম্পর্কিত কণাগুলোর সঙ্গে কোয়ান্টাম অবস্থা ভাগাভাগি করে।</p> <p>ব্ল্যাক হোলের বাষ্পীভূত হওয়া নিয়ে অনেক অগ্রগতি হলেও নতুন নতুন রহস্য উদ্ভব হচ্ছে। ২০২৩ সালে ‘ফিজিকাল রিভিউ লেটারস’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায়, ফ্যালকে এবং তাঁর সহকর্মীরা একটা যুক্তি দিয়েছেন। ইনফরমেশন প্যারাডক্স কেবল ব্ল্যাক হোলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। হকিংয়ের হিসাব নতুন করে বিশ্লেষণ করে তারা প্রস্তাব করেন যে এই সমস্যা সমস্ত বস্তুর ক্ষেত্রেই হতে পারে। হয়তো সব কিছুই সময়ের সাথে সাথে বাষ্পীভূত হচ্ছে। এটা ধাঁধাকে আরও জটিল করে তুলছে।</p> <p>ফ্যালকে বলেন, ‘এমন অনেক কিছু আছে যা আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না। তবে, জানেন তো, আরও নতুন রহস্যের উদ্ভব আমাদের সমাধানের আরও কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে।’</p> <p>ব্ল্যাক হোলের বাষ্পীভবন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রহস্য আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিচ্ছে। অবশ্য এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে এই রহস্য উদঘাটন একদিন আমাদের মহাবিশ্বের গভীর সত্য উদঘাটন করতে সহায়ক হবে।<br /> সূত্র: লাইভ সায়েন্স</p> <p><br />  </p>