<p>দেশের পরিচয় দিতে গেলে সবাই বলে ‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’। কিন্তু নদীমাতৃক এই দেশে কত নদী আছে তার কোনো সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। একেক জায়গায় রয়েছে একেক রকমের তথ্য।</p> <p>‘ফিরে এসো বাংলাদেশ, ফিরে এসো, তোমার নদীর কাছে, তেরো শ নদীর জল, যার আছে তার মতো কে আছে সচ্ছল?’ এভাবে কবিতায় তেরো শ নদীর কথা বলেছেন সব্যসাচী লেখক-কবি সৈয়দ শামসুল হক। তিনি কোথা থেকে এই সংখ্যা খুঁজে পেলেন তা জানা যায় না।</p> <p>জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদী সমন্বয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নদীব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।’ মুক্ত জ্ঞানকোষ উইকিপিডিয়ায় এই সংখ্যা ৮০০ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী’ গ্রন্থে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ‘পাউবো’ বাংলাদেশের নদীগুলোকে সংখ্যাবদ্ধ করেছে এবং প্রতিটি নদীর একটি পরিচিতি নম্বর দিয়েছে, যা ২০১১ সালে গ্রন্থাকারে ছয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা এখন ৪০৫। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, পাউবোর মূল কাজ নদী রক্ষা নয়, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নদীশাসন।</p> <p>নদী বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম ইনামুল হক ‘বাংলাদেশের নদনদী’ শীর্ষক গ্রন্থে সহস্রাধিক নদীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ করেছেন। নদীবিষয়ক প্রকাশিত অন্যান্য গ্রন্থেও দেশের নদীর সংখ্যা সহস্রাধিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>চাকরিপ্রার্থীদের জন্য প্রকাশিত বেশির ভাগ গাইডে বাংলাদেশের নদ-নদীর সংখ্যা ২৩০/৭০০ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশের নদ-নদী রক্ষার জন্য হাইকোর্টের রায়ে ২০১৩ সালে গঠিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে এ দেশের নদ-নদীর বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তাতে ৫৭টি জেলার নদ-নদীর যে সংখ্যা দেওয়া হয়েছে তার যোগফল দাঁড়ায় ৮৮৮। কিন্তু তালিকাটি পর্যালোচনা করে তাতে এতগুলো নদীর নাম পাওয়া যায় না। একটি নদী যত জেলা বা উপজেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ততবারই তালিকায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। নদীভিত্তিক তালিকা না করে জেলা-উপজেলাভিত্তিক তালিকা করার কারণে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জানানো হয়েছে যে, এটি একটি প্রাথমিক তালিকা। পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে কমিশন।</p> <p>নদী গবেষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, দেশে নদীর যে সব তালিকা পাওয়া যায় তা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নদীর সংখ্যা দুই হাজারের কম হবে না। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারি হিসাবে রংপুর বিভাগে ৮৩টি নদীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আমি নিজে ১৮০ নদীর পারে গিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে রংপুর বিভাগে নদীর সংখ্যা ২৫০-এর কম হবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এমন অনেক নদী আছে, যেগুলোকে সরকারিভাবে নদীর তালিকায় আনা হয়নি। জমির পুরনো দলিলে নদীর উল্লেখ আছে, এ রকম শত শত নদী চোখের সামনে দখল হচ্ছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন নামের সরকারি প্রতিষ্ঠান এ রকম নদীগুলোকে খাল আখ্যা দিয়ে নদীর প্রকৃত প্রস্থ কমিয়ে খনন করছে।’</p> <p>নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সম্পর্কে বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সবগুলো নদীর একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করা বেশ কঠিন। নদীর নামকরণের ক্ষেত্রে এ দেশে কোনো ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না। এখানে একই নদীকে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকার প্রবণতা রয়েছে। এমনকি কোনো একটি নদীর মাত্র পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অংশকেও এর উজানের নামের থেকে ভিন্ন নামে ডাকা হয়। নদীটির নতুন নামকরণ কোন স্থান থেকে শুরু হলো তা নির্ধারণ করা প্রায়ই সম্ভব হয় না। আবার একই নামে ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় ভিন্ন ভিন্ন নদীর অস্তিত্ব রয়েছে।’</p> <p>তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন, নদীর প্রকৃত সংখ্যা বের করার কাজটি অসম্ভব নয়। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনগণই এসব নদীর খবরদাতা। এখনো যেসব বৃদ্ধ ব্যক্তি আছেন, তাঁদের ভাষ্যেও পাওয়া যেতে পারে নদীর তথ্য। সরকারিভাবে এই কাজ করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। মাঠপর্যায়ে যাঁরা নদী নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের অনেকের কাছে ছোট ছোট নদীর তথ্য আছে। জেলা-উপজেলা প্রশাসনের কাছেও এই তালিকা পাওয়া সহজ। জেলা প্রশাসনের কাছে নদী, জলাশয় ও বিল লিজ দেওয়ার যে তালিকা আছে, সেটি গ্রহণ করে সরেজমিন এবং পুরনো দলিল খুঁজলে অনেক নদীর খবর পাওয়া যাবে। আমাদের ছোট এই দেশে প্রকৃত নদীর সংখ্যা চিহ্নিত করা হোক। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর প্রতি চরম অবহেলা-উপেক্ষা বন্ধ করা জরুরি।’</p> <p>নদীর সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য রংপুর জেলায় একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তুহিন ওয়াদুদ। গুগল মানচিত্র ও সরেজমিনে নদী চিহ্নিত করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে। এরই মধ্যে ৩৪টি নদী পাওয়া গেছে, যেখানে জেলার সাধারণ মানুষ বলতে গেলে পাঁচটির বেশি নদীর নাম বলতে পারে না। এটি সম্পন্ন হলে নদী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কাজটি একটি মডেল হতে পারে বলে তুহিন ওয়াদুদ মনে করেন।</p>