<p>দৃশ্যমান না হলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ‘তৃতীয় হাত’ ঠিকই দেখতে পেতেন সাবেক জাতীয় কোচ ওসমান খান। গত সহস্রাব্দের শেষ দশকে তাঁর এই আবিষ্কার এত বছর পরও খুব একটা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। বরং দেশের যেকোনো ক্রিকেট আড্ডা জমিয়ে দেওয়ার মতো বাড়তি হাত নিয়ে গল্পের চরিত্ররা এখনো বর্তমান।</p> <p><img alt="বিপন্ন আশায় বসতি" height="128" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/print/Magazine 2023/02-06-24/Screenshot_36.jpg" style="float:left" width="152" />সেকাল আর একালের ক্রিকেটারদের এক বিন্দুতে মিলিয়ে দেওয়া সেই ‘রিয়াল লাইফ’ গল্পে ঢোকার আগে বিষয়টি ছোট্ট করে ব্যাখ্যারও দাবি রাখে। সেটিই একটু দেওয়া যাক। পুরো শরীর আর পায়ের ব্যবহার করতে হলেও ক্রিকেটে ব্যাটার-বোলারের পরিচয় নির্ধারণ করে মূলত তাঁর ব্যবহৃত হাত। হয় সে ডানহাতি, নয়তো বাঁহাতি। তা ক্লাব ক্রিকেটে নিজ দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে তিতি-বিরক্ত ওসমান খান দেখলেন বকাঝকা করেও কাজ খুব একটা হয় না। উল্টো নিজেদের ভুলত্রুটির পেছনে দিব্যি কুযুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলেন তাঁর দলের ক্রিকেটাররা। তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকা বর্ষীয়ান কোচ একদিন বিস্ফোরণ ঘটান। খেলোয়াড়দের সামনেই চেনা কয়েকজনকে বলে বসেন, ‘বাংলাদেশে আসলে ক্রিকেটার তিন ধরনের। ডানহাতি, বাঁহাতি আর অজুহাতি!’ অর্থাৎ ক্রিকেটারদের তৃতীয় সেই হাতটি হলো অজুহাত।</p> <p>বার্ধক্যের ভার আর নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ক্রমেই ভেঙে পড়তে থাকায় ওসমান খান আজকাল বাসা থেকে বের হতে পারেন না খুব একটা। তবে অনেকটা গৃহবন্দি হলেও বাংলাদেশ ক্রিকেটের খোঁজখবর নেওয়া থেকে তাঁর বিরত থাকার কোনো কারণ নেই। খবর দেখার বা পড়ার মাধ্যম যেটিই হোক না কেন, এটি অন্তত জানার কথা যে তাঁর আবিষ্কৃত ‘অজুহাতি’রা শুধু ক্লাব ক্রিকেটের চৌহদ্দিতেই আটকে নেই। আন্তর্জাতিক আঙিনায়ও তেমন ক্রিকেটাররা এখন প্রবলভাবে বিরাজমান। তা-ও আবার যে সে জায়গায় নয়, রীতিমতো বিশ্বমঞ্চে গিয়ে দাঁড়ানো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ঠোঁটের ডগা থেকে নিত্য নামছে কত অজুহাত!</p> <p>কে বা কারা? বাংলাদেশ ক্রিকেটের খবরাখবর নিয়মিত রেখে থাকলে এতক্ষণে সেই নামগুলো আপনার অজানা নেই। শীর্ষ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান বলুন কিংবা অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, অজুহাত কে দেননি?</p> <p>এমনিতে যেকোনো বিশ্বকাপ খেলতে বেশ আগেভাগে রওনা হয়ে যায় বাংলাদেশ। ক্রিকেটারদের কন্ডিশনের সঙ্গে অভ্যস্ত করার উদ্যোগে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) কোনো কমতি রাখে না। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে রেখেও অব্যাহত সেই ধারা। মার্কিন মুলুকে কুড়ি-বিশের বিশ্ব আসর শুরুর দিন-পনেরো আগে নাজমুলরা সেখানে গিয়ে হাজির। যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচের সিরিজ বিশ্বকাপ প্রস্তুতির পক্ষে কম আদর্শ ছিল না। কে না জানে যে নিজেদের মধ্যে অনুশীলনের চেয়ে ‘গেম টাইম’কেই জমাট প্রস্তুতির প্রতিশব্দ বলে মানা হয়ে থাকে। সেই সুযোগ কোথায় কাজে লাগাবে তা না, বাংলাদেশ উল্টো প্রথম দুই ম্যাচই হেরে সিরিজ খুইয়ে বসল। তাতে লজ্জাবনত হওয়ার কথা থাকলেও সংবাদ সম্মেলনে বসে সাকিব ধরেছিলেন বিপরীত সুর। প্রস্তুতিমূলক সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচ হারার পর এই অলরাউন্ডারের মুখে প্রস্তুতির ঘাটতি আর অনুশীলনের সুযোগ-সুবিধাদি নিয়ে অনুযোগ সস্তা অজুহাতের মতোই শুনিয়েছে।</p> <p>অনেক আগে থেকে শুনিয়ে আসতে থাকা অধিনায়ক নাজমুলের অভিযোগও এখন ‘ভাঙা রেকর্ড’-এর মর্যাদা পাওয়ার পথে! মূলত অভিবাসীদের নিয়ে গড়া যুক্তরাষ্ট্র দলের কাছে ব্যাটিং ব্যর্থতায় প্রথম ম্যাচ হারার পর তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলেন দেশ ছাড়ার আগে খেলে যাওয়া জিম্বাবুয়ে সিরিজকে। ওই সিরিজে ভালো উইকেট না পাওয়ায় ব্যাটাররা ‘স্ট্রাগল’ করেছিল বলেই নাকি...। শেষ পর্যন্ত সিরিজ হারের পেছনেও দেশে ভালো উইকেটে খুব একটা খেলার সুযোগ না পাওয়াকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন তিনি। তাতে আরেকবার হাস্যরসের জোগান দিয়েছেন তিন সংস্করণের বাংলাদেশ অধিনায়ক। আঙুলের চোটে নিয়মিত অধিনায়ক সাকিব ছিটকে যাওয়ায় গত নভেম্বরে ওয়ানডে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজেদের শেষ ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার পর আরো ভালো উইকেটে খেলার বন্দোবস্তের দাবি জানিয়েছিলেন নাজমুল। সেই ব্যবস্থা যে একদমই করার চেষ্টা হয়নি, বলার সুযোগ নেই। সর্বশেষ বিপিএল শুরুর আগে কর্তাব্যক্তিরা বাংলাদেশের ব্যাটারদের এই চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিলেন যে ‘আমরা এবার ভালো উইকেট দিচ্ছি। রান না করতে পারলে সেটি ওদেরই ব্যর্থতা।’ আসরের শুরুতে কনকনে শীত থাকায় একটু এদিক-সেদিক হলেও গত বিপিএলের উইকেট মানসম্মত বলেই সনদ পেয়েছে। এর আগের আসরে সর্বোচ্চ রান করে টুর্নামেন্ট সেরা হওয়া নাজমুল অবশ্য ভালো উইকেটেও কর্তাদের দেওয়া চ্যালেঞ্জে ফেল মেরেছেন। ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি আসরটিতে ব্যাট হাতে তাঁর সময় কেটেছে দুঃস্বপ্নের মতো।</p> <p>সেই দুঃসময় যেমন এখনো পার করে আসতে পারেননি নাজমুল, তেমনি নিজেকে হারিয়ে খুঁজতে থাকা যেন শেষ হচ্ছে না লিটন কুমার দাসেরও। একযোগে তাঁদের ফর্ম হারিয়ে বসে থাকাও বাংলাদেশের বিশ্বকাপ সম্ভাবনার পারদ চড়িয়ে দিতে পারছে না। বিকল্প নেই বলে লিটনেই তবু আস্থা না রেখে পারেননি নির্বাচকরা। উল্লেখযোগ্য কোনো পারফরম্যান্স ছাড়াই সৌম্য সরকারও টিকে গেছেন। এমনকি তাঁর চোট সেরে যাওয়ার সুখবরের জন্যও নির্বাচকরা থেকেছেন কাক-প্রতীক্ষায়। একই পজিশনের জন্য তিন-চারজন থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার বিলাসিতা করার সুযোগও তাঁদের ছিল না। মানসম্মত খেলোয়াড়ের অভাব কোথায় পৌঁছালে ব্যর্থতা সত্ত্বেও পরীক্ষিত বিবেচনায় অবলীলায় বিশ্বকাপ দলে ঢুকে যাওয়া যায়!</p> <p>আবার তাঁদের বেশির ভাগই এমনও নন যে ক্রমেই আরো মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ের পূজারি হয়ে উঠতে থাকা টি-টোয়েন্টির সঙ্গে ভীষণ মানানসই। স্ট্রাইক রেট তাঁদের বেমানান বলেই চেনায়। বিশেষ করে অধিনায়ক নাজমুলের স্ট্রাইক রেটই কিছুদিন ধরে বেশি প্রশ্নের মুখে। এখন জেতার জন্য ১৮০-১৯০ রানকেও যেখানে কুড়ি-বিশের ক্রিকেটে নিরাপদ বলে মনে করা হয় না, সেখানে বাংলাদেশ শিবির নিজেদের সাধ্যের সীমাটা ধরে ১৬০-১৬৫ রানের মধ্যে। যা তাদের ব্যাটিংয়ে ‘ফায়ার পাওয়ার’-এর অভাবও ফুটিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আর ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টুর্নামেন্ট আইপিএলের সঙ্গে তুলনায় সাধারণ ক্রিকেটপ্রেমীদের বিশ্লেষণেও বাংলাদেশ এই সংস্করণে বেশ পেছনের সারির দল। সেই সঙ্গে বিশ্বকাপপূর্ব পারফরম্যান্স বড় কোনো আশার পিঠে সওয়ার হতে দিচ্ছে না। দেশে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জিতলেও ব্যাটিং ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সিরিজ হারে ভালো কিছুর আশা আরো বিপন্ন। সেই হারের পর অজুহাত খোঁজার চেষ্টা দলটিকে নিয়ে উচ্চাশায় আরো বাদ সেধে দাঁড়াচ্ছে। তা হওয়ারই কথা। বিশ্বকাপের দুয়ারে দাঁড়িয়ে এমন মনোভাবকে ভালো চোখে দেখবে কে?</p> <p>তাই নাজমুলদের নিয়ে এবার প্রত্যাশার বাড়াবাড়ি নেই। যা আছে, তা যেন আপাতত শুধু এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ, ‘বড় কিছুর প্রত্যাশা নেই, নেই কোনো দাবিদাওয়া।’</p> <p> </p> <p> </p> <p> </p> <p> </p>