<p>ইসলাম নানাভাবে মানুষকে জ্ঞান-গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছে। চিন্তা ও গবেষণাকে ইবাদত বলে ঘোষণা করেছে। তবে সঠিক পদ্ধতিতে গবেষণা করা আবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না? আল্লাহ আকাশমণ্ডলী, পৃথিবী ও তাদের অন্তর্বর্তী সব কিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট কালের জন্য।’ (সুরা : রোম, আয়াত : ৮)</p> <p>আল্লামা ইবনুল কায়্যিম জাওজি (রহ.) বলেন, ‘সেই চিন্তা ও গবেষণাই ইবাদতের মর্যাদা রাখে, যা মানুষকে উদাসীনতার জীবন থেকে সচেতন জীবনের দিকে, অপছন্দনীয় বিষয়কে পছন্দনীয় বিষয়ের দিকে, মোহ ও লালসার জীবন থেকে সংযম ও অল্পতুষ্টির জীবনের দিকে এবং দুনিয়ার কারাগার থেকে পরকালের মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।’ (মিফতাহু দারিস সাআদাত, পৃষ্ঠা-১৮৩)</p> <p><strong>ধর্মীয় গবেষণায় ভুলের কারণ</strong></p> <p>যেসব কারণে ধর্মীয় গবেষণায় ভুলভ্রান্তি হয় তার কয়েকটি হলো—</p> <p>১. সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়াহুড়া করা : যেকোনো বিষয়ে গবেষণায় ধৈর্য ও অধ্যবসয় অপরিহার্য। গবেষণার সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাড়াহুড়া করা নিষেধ, বিশেষত ধর্মীয় কোনো বিষয়ে গবেষণা করা হলে। কেননা এর সঙ্গে মানুষের ঈমান-আমলের প্রশ্ন জড়িত। পবিত্র কোরআনের অসংখ্য আয়াতে তাড়াহুড়া করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ত্বরাপ্রবণ, শিগগির আমি তোমাদেরকে আমার নিদর্শনাবলি দেখাব। সুতরাং তোমরা আমাকে ত্বরা করতে বোলো না।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩৭)</p> <p>২. পূর্ব চিন্তাকে গুরুত্ব দেওয়া : গবেষণা শুরু করার আগেই ব্যক্তি যদি সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনো চিন্তা ও অনুমানকে অন্তরে ধারণ করে এবং নিজের পূর্ব চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়, তবে গবেষণায় ভুল হওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। ভিত্তিহীন পূর্ব চিন্তা ধারণা, অনুমান ও প্রবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম ধারণা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে নিষেধ করে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের বেশির ভাগ অনুমানেরই অনুসরণ করে, সত্যের পরিবর্তে অনুমান কোনো কাজে আসে না, তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ৩৬)</p> <p>৩. অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে গ্রহণ : ইসলামী বিষয়ে গবেষণার একটি শর্ত হলো নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে গ্রহণ করা। অনির্ভরযোগ্য ও অবিশ্বস্ত সূত্র থেকে উপাত্ত গ্রহণ করে কখনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তার আনুগত্য কোরো না, যার চিত্তকে আমি আমার স্মরণে অমনোযোগী করে দিয়েছি, যে তার খেয়ালখুশির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ২৮)</p> <p>রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার ওপর মিথ্যারোপ করল সে জাহান্নামে তার আবাস তৈরি করল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৯৫১)</p> <p>৪. মর্যাদা ও গুরুত্ব নির্ধারণে ভুল করা : ব্যক্তি, বস্তু, স্থান ও বিষয়ের মর্যাদা ও গুরুত্ব নির্ণয়ে ভুল করলে ব্যক্তির গবেষণায় ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ক্ষেত্রে শরিয়ত যাকে যে মর্যাদা দিয়েছে তাকে সে স্থানে রাখতে হবে। মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। যেমন—হাদিসে এসেছে, ‘নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মুসলিমকে সম্মান করা, কোরআনের ধারক-বাহক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রতি সম্মান দেখানো মহান আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৪৩)</p> <p>উল্লিখিত হাদিসের বাহ্যিক দাবি হলো আল্লাহর মর্যাদা রক্ষার মতো বৃদ্ধ মুসলিম, কোরআনের ধারক ও ন্যায়পরায়ণ শাসকের মর্যাদা রক্ষা করাও ফরজ। অথচ কোনো ফকিহ এটাকে ফরজ বলেননি, বরং সাধারণ দায়িত্ব-কর্তব্য বলেছেন।</p> <p>৫. দলিলের স্তর নির্ণয়ে ভুল করা : শরিয়তের দলিলগুলোর মধ্যে মর্যাদাগত তারতম্য আছে। যেমন—কোরআনের মর্যাদা সবার ওপরে। এরপর যথাক্রমে হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইসতিহসান, উরুফ ইত্যাদি। আবার আয়াত ও হাদিসগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক মর্যাদাগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন—একটি আয়াত রহিত, অন্যটি রহিতকারী; একটি আয়াতের বক্তব্য সুস্পষ্ট, অন্য আয়াত ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে; একটি হাদিস অবিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত, অপরটি বিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত—এগুলোর মর্যাদা সমান নয়। এর একটি অপরটির ওপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং শরিয়তের দলিলগুলোর স্তর না জানলে গবেষণায় ভুল হবে।</p> <p>৬. ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা : ইসলামী বিষয়গুলোর ওপর গবেষণা করতে হলে ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক, বিশেষ করে মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত লাভের পর থেকে ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস, ঐতিহাসিক ঘটনা, বিভিন্ন শাস্ত্রের কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের জীবনচরিত জানা আবশ্যক। কেননা শরিয়তের এমন অনেক বিষয় আছে যেগুলো সমকালীন আলেমদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে (ইজমা) গৃহীত বা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আবার মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে আলেমদের ভেতর তারতম্য আছে। যার একজনের মতের বিপক্ষে অন্যজনের মত গ্রহণযোগ্য নয়।</p> <p>৭. আরবি ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞতা : আরবি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎস কোরআন ও হাদিস। যার ভাষা আরবি। কোরআন-হাদিস ছাড়াও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রামাণ্য গ্রন্থগুলো প্রধানত আরবি ভাষায় রচিত। তাই আরবি ভাষায় বিশেষ দক্ষতা না থাকলে ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণায় ভুল করার সমূহ আশঙ্কা থাকে। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান সাধ্যানুযায়ী আরবি ভাষা শিখবে। যেন সে আরবি ভাষায় কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ ও কোরআন তিলাওয়াত করতে পারে এবং যেসব জিকির ও অজিফা আরবি ভাষায় পাঠ করা ফরজ তা যেন আরবিতে পড়তে পারে। একইভাবে তাসবিহ, তাশাহহুদ ইত্যাদি পড়তে পারে। এরপর যদি কোনো মানুষ শেষ নবী (সা.) ও কোরআনের ভাষায় আরো দক্ষতা অর্জন করে তবে তা উত্তম।’ (আর রিসালা, পৃষ্ঠা-৪৮-৪৯)</p> <p>৮. গবেষণার পরিসর না জানা : শরিয়তের কিছু বিষয় এমন যেখানে গবেষণার অবকাশ আছে এবং কিছু বিষয় রয়েছে যা পূর্ব থেকে মীমাংসিত, এসব বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবকাশ নেই। একজন গবেষক যখন মীমাংসিত বিষয়গুলো সম্পর্কে জানবে, তখন সে গবেষণার পরিধি নির্ধারণে ভুল করবে। যেমন—সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর মর্যাদা ও সম্মান একটি মীমাংসিত বিষয়। তাঁরা সবাই ন্যায়পরায়ণ ও ক্ষমাপ্রাপ্ত। সুতরাং তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা ভুলত্রুটি চিহ্নিত করে কেউ যদি ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে চায় তবে সে নিশ্চিত ভুল করবে।</p> <p>৯. চার স্তম্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে : গবেষক আলেমরা ইসলামী জ্ঞান-গবেষণায় চারটি বিষয়কে স্তম্ভ ঘোষণা করেছেন। এগুলো পাওয়া না গেলে গবেষণায় ভুল হতে পারে। বিষয়গুলো হলো—এক. আহলে দিল তথা বিশুদ্ধ চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসের অধিকারী আলেমের সাহচর্য লাভ, দুই. আহলে ফন তথা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তির অধীনে পাঠ গ্রহণ, তিন. গভীর অধ্যয়ন ও অধ্যবসয়, চার. অর্জিত জ্ঞান আত্মস্থ করা। মুহাম্মদ ইবনে সিরিন (রহ.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই এ জ্ঞান দ্বিনের অংশ। সুতরাং কার কাছ থেকে তোমরা তোমাদের দ্বিন গ্রহণ করছ তা লক্ষ্য রাখো।’ (আল কামিল : ১/২৫৪)</p> <p>১০. আল্লাহর ভয় না থাকলে : ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণা আল্লাহভীতি ও পরকালীন জবাবদিহির ভয় গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহভীতি না থাকলে ব্যক্তির জন্য হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে আল্লাহ তাঁর কাজকে সহজ করে দেবেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দেবেন।’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৪)</p> <p>আল্লাহ সবাইকে সঠিক নিয়মে গবেষণা করার তাওফিক দিন। আমিন।<br />  </p>