<p>মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সিন্দুরখান ইউনিয়নের ডোবাগাঁও বাহরুল উলুম দাখিল মাদরাসার কৃষি বিষয়ের এমপিওভুক্ত শিক্ষক মো. হেলাল আহমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে অনিয়ম-দুর্নীতির। তিনি শ্রীমঙ্গল উপজেলা আওয়ামী কৃষক লীগের সদস্য সচিব ও চা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।</p> <p>মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষক-শিক্ষার্থী সূত্রে জানা যায়, শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য, সদ্য সাবেক কৃষিমন্ত্রী উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদের ঘনিষ্ঠজন হওয়ার সুবাদে মো. হেলাল আহমদ শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের ডোবাগাঁও বাহরুল উলুম দাখিল মাদরাসার এমপিওভুক্ত শিক্ষক পদে কর্মরত থাকার পরও বছরের পর বছর মাদরাসায় ক্লাস করছেন না। মাদরাসার সিংহভাগ শিক্ষার্থীরা তাকে চেনেনও না। কখনো ক্লাস নিতে দেখেনি শিক্ষার্থীরা। কয়েক বছর ধরে তিনি মাদরাসায় মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করেন। অথচ শিক্ষক হাজিরা খাতায় তার উপস্থিতি বিদ্যমান।</p> <p>হেলাল আহমদের এ বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’ হলেও প্রভাবশালী হওয়ার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ক্ষমতার প্রভাবে মাদরাসায় শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ না নিয়েই মাস শেষে দৈনিক হাজিরা খাতায় একসাথে স্বাক্ষর করে মাসের পর মাস ঠিকই বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করে আসছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।</p> <p>স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, ডোবাগাঁও বাহারুল উলুম দাখিল মাদরাসার কৃষি শিক্ষার সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ হেলাল আহমদ উপজেলা কৃষক লীগের সদস্যসচিব হওয়ায় এবং সাবেক কৃষিমন্ত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্যের প্রিয়ভাজন হওয়ায় মাদরাসায় তার একটা প্রচ্ছন্ন ও সুস্পষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল। ফলে তিনি বছরের পর বছর মাদরাসায় ক্লাস না করে প্রতি মাসে বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করেছেন। </p> <p>সরজমিনে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ৪ নম্বর সিন্দুরখান ইউনিয়নের ডোবাগাঁও বাহারুল উলুম দাখিল মাদরাসায় গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, উপজেলা কৃষক লীগের সদস্য সচিব মোহাম্মদ হেলাল আহমদ উক্ত মাদরাসার কৃষি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাদরাসার শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ না নিয়েই মাসের পর মাস বেতন-ভাতাদি উত্তোলন করেছেন। সাবেক কৃষিমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তার এসব অনিয়ম-অপকর্মের বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দটিও করতে পারেননি।</p> <p>গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিনি মাদরাসায় আসা-যাওয়া শুরু করেছেন।</p> <p>প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে মাদরাসার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহবুব আলম বলেন, ‘আমি এ মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণি থেকে লেখাপড়া করছি। এবার দশম শ্রেণিতে পড়ছি। আমি কোনোদিন হেলাল স্যারকে আমরার ক্লাসে পাইনি। একেবারে সত্য কথা হলো, করোনাকাল থেকে এখন পর্যন্ত মাদরাসার কোনো শ্রেণি কার্যক্রমে স্যারের অংশগ্রহণ আমার চোখে পড়েনি। তিনি প্রভাবশালী নেতা হওয়ার কারণে এতদিন কেউ কিছু বলেনি। তবে এই মাস থেকে দেখছি তিনি মাঝে-মধ্যে মাদরাসায় আসা-যাওয়া করছেন।’ </p> <p>দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আব্দুস সামাদ বলেন, ‘স্যার এত বছর ক্লাস না করিয়েও নিয়মিত বেতন তুলেছেন, আর মাদরাসায় উপস্থিত না থেকেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন, এটা কতটুকু ঠিক।’</p> <p>অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর বলেন, ‘হেলাল স্যার মাঝে-মধ্যে মাদরাসায় আসতেন, তবে ক্লাস করাতেন না। স্যারের ক্লাস আব্দুল আলী ও রিংকু স্যার করাতেন।’ </p> <p>মাদরাসার অস্থায়ী শিক্ষক মো. আব্দুল আলী বলেন, ‘আমি গত দুই বছর যাবত হেলাল স্যারের পক্ষে ক্লাস করিয়ে আসছি। তিনি প্রতি মাসে আমাকে ৫ হাজার টাকা সম্মানী দিতেন।’</p> <p>মাদরাসার এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের কৃষি বিষয়ের শিক্ষক হেলাল  গত দুই বছর ধরে শ্রেণি কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না। তার স্থলে আব্দুল আলী ও রিংকু মিয়া নামের দুইজন অস্থায়ী শিক্ষক মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন। হেলাল মিয়ার এমপিওভুক্ত হিসেবে প্রতি মাসের বেতন ২৩ হাজার ৪৪৫ টাকা। এ বেতনের টাকা থেকে ওই দুইজন অস্থায়ী শিক্ষককে তিনি প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে দিচ্ছেন। বাকি টাকা তিনি উত্তোলন করে নিয়ে যান।’</p> <p>ডোবাগাঁও বাহরুল উলুম দাখিল মাদরাসার সুপারিনটেনডেন্ট ছাইফুদ্দিন মো. ইয়াহইয়া বলেন, ‘হেলাল সাহেব গত কয়েকদিন যাবত মাদরাসায় নিয়মিত আসছেন। এর আগে যা হইছে তা বাদ দিয়ে দেন। আমাদের মাদরাসায় শিক্ষক কম। তিনি ক্লাস না করালেও তার বদলে দুইজন অস্থায়ী শিক্ষক ক্লাস করিয়েছেন। এতে প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে।’</p> <p>তিনি ক্লাস না করিয়ে বেতন ভাতা তুলছেন এটি একটি অনিয়ম। আর এ অনিয়মের সাথে সুপার হিসেবে আপনিও জড়িত এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘অনিয়ম ঠিক আছে, আমি আপনারে কই-বেশি দুরে যাওয়া লাগত না, আমাদের সিন্দুরখান ইউনিয়নেও আরো অনেক প্রতিষ্ঠানে এরকম অনেক অনিয়ম আছে। মাদরাসাগুলো এমনভাবে চলছে যার কারণে অনিয়ম নাই এমন কথা বলব না। অনিয়মকে তো অনিয়মই বলব। তবে মাদরাসার উন্নয়ন কাজে সে মাঝেমধ্যে ডোনেসন করেছে। যেহেতু বেচারা মন্ত্রীর লগে চলছে, সে কথাগুলা কি শিক্ষা অফিসার জানে না? উনারাওতো কোনো ভূমিকা রাখছে না।’</p> <p>ডোবাগাঁও বাহারুল উলুম দাখিল মাদরাসার সদ্য বিলুপ্ত ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেখে আসছি শিক্ষক হেলাল আহমদ মাদরাসায় ক্লাস না করিয়েও নিয়মিত বেতন ভাতা তুলে চলেছেন। আমার আগের সভাপতির সময়েও তিনি এভাবে ক্লাস না করিয়েই বেতন-ভাতা নিয়েছেন। আমি দায়িত্ব লাভের পর একবার নয়, বার বার সুপারকে বলেছি ক্লাস না করিয়ে এভাবে বেতন ভাতা দেওয়া ঠিক না। এত বছর এ বিষয়ে বলার মতো সাহস কারো ছিল না। খবর নিয়ে দেখুন রেকর্ড কি। সে মন্ত্রীর সঙ্গে ঘুরত, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে বসে থাকত।’</p> <p>শ্রীমঙ্গল উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা দীলিপ কুমার বর্ধন বলেন, ‘বিষয়টি জেনেছি। এরআগে আমার কার্যালয়ের একাডেমিক সুপারভাইজারকেও মাদরাসায় পাঠিয়েছি। তিনি রিপোর্ট দিয়েছেন। তবে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ লিখিতভাবে আমাদের কিছু জানায়নি।’</p> <p>মৌলভীবাজার জেলা শিক্ষা অফিসার মো. ফজলুর রহমান বলেন, ‘মাদরাসার ম্যানেজিং কমিটি আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি। মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকে শিক্ষক হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা, নিয়মিত বেতন তোলা এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকের অনুপস্থিতিতে অন্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এসব নিয়মবর্হিভূত বেআইনি। যদি তদন্ত করে প্রমাণিত হয় তাহলে অনিয়মে জড়িতদের ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</p> <p>শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ও ডোবাগাঁও মাদরাসা সদ্য গঠিত ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মো. আবু তালেব বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। আজই আমি মাদরাসায় যাব, তদন্ত করবো এবং বোর্ডে আলাপ করব। এ বিষয়ে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’</p>