<p>রংপুরের ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ ১০৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে। উত্তরবঙ্গের অক্সফোর্ডখ্যাত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ গড়ার কারখানা হিসেবে সুপরিচিত। শিক্ষার আলো বিতরণ করে এ কলেজ যুগের পর যুগ ধরে যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তুলছে।</p> <p>১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার নাম অনুসারেই কলেজটির নামকরণ করা হয়। ১৯১৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এই কলেজে আইএ এবং বিএ ক্লাস চালুর অনুমতি দেয়। শুরুতে প্রায় দুই বছরের জন্য রংপুর জেলা পরিষদ ভবনে কলেজটির পাঠদান কার্যক্রম চললেও, ১৯১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মূল ভবনের উদ্বোধন করা হয়। জার্মান নাগরিক ড. ওয়াটকিন ছিলেন কলেজটির প্রথম অধ্যক্ষ।</p> <p>শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠের ১০৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রোববার (১০ নভেম্বর) দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন করা হয়েছে। নবীন-প্রবীণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এই আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে প্রস্তুত। কলেজ ক্যাম্পাসজুড়ে চলছে সাজসাজ রব। গত শনিবার রাতে ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলোকে আলোকসজ্জা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।</p> <p>প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনে রয়েছে বর্ণাঢ্য আনন্দ শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, কেক কাটা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। “এসো তবে প্রাণে প্রাণে মিলি সবে” স্লোগানে জি.এল. হোস্টেল মাঠে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।</p> <p>দুই পর্বের অনুষ্ঠানমালায় প্রথম পর্বের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ) অতিরিক্ত সচিব মো. রবিউল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুগ্ম সচিব মো. নুরুজ্জামান, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) প্রফেসর ড. এ কিউ এম শফিউল আজম, কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোস্তাফিজুর রহমান, উপাধ্যক্ষ ড. রেহেনা খাতুন, শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর দিলীপ কুমার রায়, এবং কারমাইকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রকিবুস সুলতান মানিক। এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর এ বি এম রেজাউল করীম।</p> <p>দ্বিতীয় পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি আমিনুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ছিলেন রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলী এবং রংপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল। এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন কারমাইকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোস্তাফিজুর রহমান।</p> <p>তথ্য অনুযায়ী এই কলেজ প্রতিষ্ঠার পেছনে ছিল অনেক কারণ ও স্বপ্ন। ১৮৩২ সালে রংপুর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সেই সময়ে কোনো কলেজ না থাকায় উচ্চ শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের ভারতের কোচবিহারে যেতে হতো। একটি মানসম্মত কলেজ প্রতিষ্ঠা ছিল রংপুরবাসীর বহু দিনের স্বপ্ন।</p> <p>১৯১৩ সালে অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারন কারমাইকেল রংপুর পরিদর্শনে এলে তাকে সংবর্ধনা দেওয়ার সময় কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলা হয়। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও গাইবান্ধার জমিদার এবং শিক্ষানুরাগীদের দানে সংগৃহীত অর্থ ও জমিদারদের দানকৃত ৯০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে কারমাইকেল কলেজ। এটি রংপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চমাধ্যমিক, ডিগ্রি, সম্মান, ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন।</p> <p>অবিভক্ত বাংলার যে কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খ্যাতি অর্জন করেছিল, তার মধ্যে কারমাইকেল কলেজ অন্যতম। ইংরেজ আমলে অবিভক্ত বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ও প্রচারে এই কলেজের অবদান অনস্বীকার্য। তৎকালীন রংপুর, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, আসাম ও সংলগ্ন এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টিতে এই কলেজের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। ২০০১ ও ২০০৬ সালে দুটি পৃথক আইন পাস করে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা হয়, তবে এই আইন কার্যকর হয়নি।</p> <p>৬১০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট প্রশস্ত ইন্দোস্যারানিক স্থাপত্যশৈলীর মূল ভবনটি প্রথম দর্শনেই পর্যটকদের মুগ্ধ করে। ভবনটি রংপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থাপনা হওয়ায় দেশি-বিদেশি বহু পর্যটক প্রতিবছর এখানে আসেন। কলেজে রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ভবন, ডরমিটরি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কিউএ মেমোরিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয়, ‘হোয়াইট হাউস’ নামে পরিচিত একটি ভবন, অডিটোরিয়াম, মসজিদ, ক্যান্টিন, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং একটি টালি ভবন।</p> <p>কলেজের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত উন্মুক্ত মঞ্চটি ‘বাংলা মঞ্চ’ নামে পরিচিত। এটি কলেজের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র। কলেজের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার ফাঁকে বাংলা বিভাগের পাশে লিচুতলার সংস্কৃতি মঞ্চে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজে মেতে ওঠেন। এছাড়াও, স্পন্দন, কানাসাস, বিতর্ক পরিষদ, কাকাশিস, আবৃত্তি সংসদ, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ একাধিক সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, বিতর্ক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে।</p> <p>কারমাইকেল কলেজ বহু কৃতী শিক্ষার্থী জন্ম দিয়েছে, যারা দেশ ও বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মুস্তাফিজার রহমান, দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার আনিসুল হকসহ অনেকে এই কলেজে পড়াশোনা করেছেন।</p> <p>শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, এই কলেজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরা। আমাদের কলেজের অনেক সুনাম আছে দেশে-বিদেশে। অনেক কৃতী শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সাম্প্রতিককালে চব্বিশের জুলাইয়ের বিপ্লবে কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের সাহসী অংশগ্রহণ গর্বের বিষয়। শতবর্ষী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি গর্বিত।</p> <p>কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর দিলীপ কুমার রায় বলেন, কারমাইকেল কলেজ আমার জন্য অনেক আবেগের জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই কলেজের ছয়জন শিক্ষক ও তিনজন শিক্ষার্থী জীবন দিয়েছেন। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেক অবদান ছিল, যা আমাদের জন্য গর্বের ইতিহাস।</p> <p>প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর মো. শফিক হোসেন বলেন, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ, ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনসহ নানা প্রেক্ষাপটের সাক্ষী কারমাইকেল কলেজ একটি ইতিহাস। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শতবর্ষের গৌরব ও অর্জন অবিস্মরণীয়।</p>