সম্প্রতি কয়েকটি হাই-প্রফাইল দুর্ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ব্যবহারকারী দাবি করেছেন, বিমান দুর্ঘটনা নাকি বেড়ে চলেছে। অনলাইনে ভয়াবহ কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে একের পর এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ও সংকটময় পরিস্থিতি দেখা গেছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহনমন্ত্রী শন ডাফি সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ ধরনের শঙ্কা কমানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক বিমান দুর্ঘটনাগুলো ছিল ‘একদমই ব্যতিক্রমধর্মী’।
ডাফির এই মন্তব্য আসে কয়েকটি গুরুতর দুর্ঘটনার পর, যার মধ্যে একটি ছিল জানুয়ারিতে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বাণিজ্যিক বিমান ও একটি সামরিক হেলিকপ্টারের মধ্যকার আকাশে সংঘর্ষ, যেখানে ৬৭ জন নিহত হয়। এ ছাড়া কানাডার টরন্টোতে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে অবতরণের সময় একটি বিমান উল্টে যাওয়ার ঘটনাও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে ও আতঙ্ক আরো বাড়ায়।
যদিও এই বিষয়ে জনমত জরিপ সীমিত, তবে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা ইঙ্গিত দিয়েছে, দুর্ঘটনার এই চমকপ্রদ চিত্র কিছু মার্কিন ভোক্তার বিমানভ্রমণের প্রতি আস্থার ওপর প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী বিমান দুর্ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে বিবিসি ভেরিফাই দেখিয়েছে, গত দুই দশকে বিমান দুর্ঘটনার হার সাধারণত কমতির দিকে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন সুরক্ষা বোর্ডের (এনটিএসবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনার সংখ্যা কমেছে, যদিও এই সময়ে ফ্লাইটের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫২ ছিল, যা আগের বছরের জানুয়ারির তুলনায় (৫৮) এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারির তুলনায় (৭০) কম।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইসিএও) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতিমিলিয়ন বিমান ছাড়ার ওপর ভিত্তি করে দুর্ঘটনার হারও কমেছে।
বিশ্বব্যাপী বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা কমলেও কিছু বছর বড় দুর্ঘটনার কারণে তা হঠাৎ করে বেড়ে যায়।
যেমন ২০১৪ সালে দুটি বড় দুর্ঘটনা এই প্রবণতাকে উল্টে দেয়। মার্চে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের এমএইচ৩৭০ ফ্লাইটটি নিখোঁজ হয়, যেখানে ২৩৯ জন যাত্রী ছিল। এরপর জুলাইয়ে একই এয়ারলাইনসের আরেকটি বিমান এমএইচ১৭ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত হলে প্রায় ৩০০ জন মারা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যানবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক স্যার ডেভিড স্পিগেলহালটার বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার চেয়ে প্রাণহানির সংখ্যা হিসাব করলে তা খুবই অস্থিতিশীল হবে এবং একটি বড় দুর্ঘটনাই পরিসংখ্যানকে নাটকীয়ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।’
ফিনল্যান্ডে বিমান দুর্ঘটনার সাবেক প্রধান তদন্তকারী ইসমো আলতোনেন জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোর দুর্ঘটনাগুলো বিমান নিরাপত্তা কমে যাওয়ার কোনো ইঙ্গিত দেয় না।
তিনি বলেন, ‘এই সময়ের দুর্ঘটনাগুলো ছিল বিভিন্ন ধরনের এবং এগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র নেই।’
নেটিজেনদের প্রভাব
সিনিয়র লেকচারার ও সাবেক পাইলট মার্কো চান বলেন, ‘বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে মানুষের মধ্যে এই ধারণা আরো ছড়িয়ে পড়ছে।’
এ ছাড়া বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক দুর্ঘটনা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক মনোযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে মাঝ আকাশে বিমানের একটি দরজা খুলে যাওয়ার ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি দুর্ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করা হয় এবং সেই অনুযায়ী পাইলট প্রশিক্ষণকে উন্নত করা হয়। আলতোনেন বলেন, ‘আধুনিক সিমুলেটরগুলো এখন এতটাই উন্নত যে এগুলোকে বাস্তব বিমানের মতোই মনে হয়।’
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও নিরাপত্তা লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা, লাইসেন্স স্থগিতকরণ ও পরিচালনায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। নিরাপত্তা মান বজায় না রাখলে কোনো কোনো এয়ারলাইনসকে দেশ বা অঞ্চল থেকে নিষিদ্ধও করা হতে পারে।
আকাশপথ এখনো সবচেয়ে নিরাপদ
সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার পরও বিমানভ্রমণ এখনো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ভ্রমণ মাধ্যম। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন দপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশটিতে পরিবহনসংক্রান্ত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৯৫ শতাংশই ঘটেছে সড়কে, যেখানে বিমান দুর্ঘটনার হার ছিল এক শতাংশেরও কম।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের একই বছরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ কোটি মাইল যাত্রায় যাত্রীবাহী বিমানে মৃত্যুর হার ছিল মাত্র ০.০০১, যেখানে যাত্রীবাহী যানবাহনে তা ছিল ০.৫৪। আলতোনেন বলেন, ‘যখন আপনি বিমান ধরতে যাবেন, তখন সাবধানে গাড়ি চালান। কারণ বিমানবন্দরে পৌঁছনোর পথই পুরো যাত্রার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ।’