ইবরাহিম ইবনে ইয়াজিদ আন নাখয়ি (রহ.) ফিকহশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ ইমাম ও নির্ভরযোগ হাদিস বর্ণনাকারী। তিনি ছিলেন সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার উত্তরসূরি। তিনি তা অর্জন করেন মামা আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ (রহ.)-এর কাছ থেকে। যিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর ছাত্র ছিলেন।
এ ছাড়া ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) আলকামা, মাসরুক, আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রহ.)-এর কাছ থেকে জ্ঞানার্জন করেন।
তিনি ছিলেন চিন্তা, গবেষণা ও মাসআলা উদ্ভাবনে সূক্ষ্ম জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তাঁর ব্যাপারে এটাও বলা যায় যে তিনি ইরাকে ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানবীয় জ্ঞান-বুদ্ধির প্রয়োগের মাধ্যমে মাসআলা উদ্ভাবনের সূচনা করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন হাম্মাদ ইবনে আবি সুলাইমান (রহ.)।
আর তাঁর উত্তরসূরি ছিলেন ইমাম আবু হানিফা (রহ.)। পাশাপাশি তিনি একজন উঁচু স্তরের বুজুর্গ ছিলেন। অধিক ইবাদত, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও আল্লাহভীতির জন্য মানুষ তাঁকে বিশেষ সমীহ ও সম্মান করত।
ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ৪৭ হিজরিতে ইরাকের কুফা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর বংশপরম্পরা নিম্নরূপ—ইবরাহিম ইবনে ইয়াজিদ ইবনে আসওয়াদ ইবনে আমর বিন রাবিআ। তাঁর উপনাম আবু ইমরান বা আবু আম্মার। কুফায় বসবাস করায় তাঁকে কুফি এবং নাখা গোত্রের সদস্য হওয়ায় তাঁকে নাখয়ি বলা হয়। নাখা ইয়েমেনের একটি বড় গোত্র। অনেকেই মনে করেন, ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর দোয়ার ফসল। তিনি নাখা গোত্রের জন্য দোয়া করেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আমি মহানবী (সা.)-কে এই নাখা গোত্রের লোকদের জন্য দোয়া করতে অথবা প্রশংসা করতে শুনেছি। এমনকি তা শুনে আমার ভেতর আকাঙ্ক্ষা হয় আমি যদি তাদের একজন হতাম।’
(মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৩৮২৬)
নাখা গোত্রে এই দোয়ার প্রতিফলন নানাভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আল্লাহ তাদের ভেতর বহু বড় আলেম সৃষ্টি করেন। যেমন—ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.)-এর পিতা ইয়াজিব ইবনে আসওয়াদ, তাঁই দুই মামা আসওয়াদ ও আবদুর রহমান এবং তাঁর চাচা আলকামা (রহ.)। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ফিকহের জন্য বিখ্যাত পরিবারে জন্ম নেন। তিনি তাদের কাছ থেকে ফিকহ শেখেন। অতঃপর আমাদের সঙ্গে বসে হাদিস অর্জন করেন এবং তা তাঁর ফকিহ পরিবারের কাছে পৌঁছে দেন। শৈশবে পিতার সঙ্গে হজের সফরে আসেন তিনি। এ সময় তিনি উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর বরকতময় সান্নিধ্য লাভ করেন।
ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী ও ধীশক্তির অধিকারী একজন আলেম। তিনি একই সঙ্গে একজন কোরআনের হাফেজ, প্রসিদ্ধ কারি, মুহাদ্দিস ও ফকিহ ছিলেন। তবে ফিকহশাস্ত্রে তাঁর অবদান সবচেয়ে বেশি। যেসব মহান মনীষীর হাতে ফিকহশাস্ত্রের ভিত রচিত হয়েছিল তিনি তাদের অন্যতম। তরুণ বয়সেই তিনি পাঠদান শুরু করেন।
ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ছিলেন একজন আল্লাহভীরু ও অধিক ইবাদতকারী বুজুর্গ। তিনি এক দিন রোজা রাখতেন এবং এক দিন রোজা ছেড়ে দিতেন। সময় পেলেই তিনি নামাজ পড়তেন। তিনি অনুভব করতেন নামাজের সময় সত্যিই তিনি আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ফলে নামাজের পর তাঁর চোখে-মুখে আল্লাহর ভয় ফুটে উঠত। আমাশ (রহ.) বলেন, আমি কখনো কখনো ইবরাহিম (রহ.)-কে নামাজ পড়তে দেখতাম। তিনি আমাদের কাছে ফিরে এসে এমনভাবে কান্না করতেন যেন তিনি অসুস্থ।
ইবরাহিম ইবনে নাখয়ি (রহ.) খুব কম কথা বলতেন। আশআস ইবনে সাওয়ার (রহ.) বলেন, আমি ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.)-এর কাছে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত বসেছিলাম। তিনি কোনো কথা বলেননি। তাঁকে কোনো প্রশ্ন করা না হলে তিনি কথা বলতেন না। আল্লাহ তাঁকে উত্তম চরিত্র দান করেন। তিনি কারো সঙ্গে বিবাদ করতেন না, বিতর্ক করতেন না। ইবরাহিম নাখয়ি (রহ.) ও তাঁর স্ত্রী প্রত্যেক বৃহস্পতিবার কান্না করতেন। তারা বলতেন, আজ আমাদের আমল আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে।
মহান এই মনীষী ৯৬ হিজরিতে কুফায় ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৯ বছর। আল্লাহ তাঁর কবরকে শীতল করুন। আমিন।
সূত্র : সিয়ারু আলামিন নুবালা : ৪/৫২১; আল আনসাব : ১৩/৬৩।