পাখির পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। তাদের জন্য নেই কোনো বর্ডার পুলিশ। কিন্তু মানুষের জন্য মানুষই সেই ব্যবস্থা করে। এক মানুষের ভাষা আরেক মানুষ বোঝে না।
পাখির পাসপোর্ট-ভিসা লাগে না। তাদের জন্য নেই কোনো বর্ডার পুলিশ। কিন্তু মানুষের জন্য মানুষই সেই ব্যবস্থা করে। এক মানুষের ভাষা আরেক মানুষ বোঝে না।
ভিনদেশে যে কিছু অন্তর্জ্বালা থাকবেই তা বুঝি।
এখানে, এই বিলেতে, ইতিহাসের শিক্ষক পড়ান ক্রীতদাসের দেশের খরার, দরিদ্রের দেশের বন্যার কাহিনি। কিন্তু ডিয়ার টিচার, একবারও কি ভেবেছেন, আপনাদেরও বহু আগে তারা মুক্ত ছিল? তাদের মাটি তাদেরই ছিল, নিজের ভাষা ছিল? পশু বধের পর পুড়িয়ে খাওয়ার প্রক্রিয়া বের করেছিল তারাই? বন্যা-বর্ষার পরে নিজস্ব ব্যবস্থাপত্রে করেছে চাষ, ছিল নিজ সংস্কৃতি, মণি-মাণিক্য, কোহিনূর। তাই যাযাবর বাণিজ্যে কার নৌকা কোথায় আগে মাটি ছুঁয়েছে, তার চেয়ে বিবেচ্য হতে পারত সবার আদি পরিচিতি।
বিলেতে আমার এই পরিযায়ী জীবনে তিন-তিনটি দশক গেল—রাতে, শীতে, ঘামে, প্রীতে, বিনয়ে, দুর্বিনয়ে কিন্তু কোনো দিন মনে হয়নি আমার জন্মদেশ ও জন্মভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।
ইংল্যান্ড এমনই এক দেশ, যার সঙ্গে আমাদের লাভ অ্যান্ড হেইট সম্পর্ক। শুধু আমাদের নয়, যেসব দেশ তাদের উপনিবেশ ছিল, তাদের সঙ্গেও। সে ইনার গিল্ট ও আপাত-অপরাধবোধ থেকেই কি না কে জানে, এ দেশে সেসব দেশের বহুজাতিক মানুষের আগমনের দুয়ার খোলা ছাড়া উপায় ছিল না। তাতে বর্ণবাদীদের মন খারাপ হলেও খয়েরি হয়ে গেছে এ দেশে মানুষের গাত্রবর্ণ। কিন্তু এই বৈচিত্র্য বিকশিত হতে দেওয়ার কারণে সারা বিশ্বে ব্রিটেনের মর্যাদা বেড়েছে বৈ কমেনি। পূর্ব লন্ডনের বহুমাত্রিকতার জন্যই লন্ডন ২০১২ সালের অলিম্পিক খেলার বিড জিতেছিল। এখানে ৫৫ শতাংশ এশীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ, ১৪ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ! বুঝুন, নিজ দেশে এ অঞ্চলে ককেশিয়ানরাই সংখ্যালঘু। এখন এই ৫৫ শতাংশের মধ্যে ৩২ শতাংশই আবার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এমনকি এর বেশির ভাগ মানুষই ঠিক আমারই মতো—জন্মসূত্রে বাংলাদেশি।
বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ভারতের পর যে দেশের অবদান ও সমর্থন ছিল সবচেয়ে বেশি, তা এই যুক্তরাজ্য। জনসংখ্যার দিক থেকেও বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার পরই এখানে অধিকসংখ্যক বাঙালির আবাস। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এটা ছিল বাংলাদেশের তৃতীয় ঘাঁটি। আজও তার হয়নি ব্যত্যয়। এখানেই বাংলাদেশের অনুরূপ এক ক্ষুদ্র বাংলাদেশ, যা সারা বিশ্বের বাঙালিদের এক রোল মডেল।
এবার আমার কথা বলি। দেশে থাকতেই জানতাম এ উপসর্গগুলোর কারণেই বিলেতে বাংলাদেশের জন্য করার সুযোগও অনেক। সেই বিদেশেরই দৈবের বশে আমি আজ এক গল্পের ফেরিওয়ালি। জীবিকা বিচারে বলা যায়, ছিলাম শিক্ষক ও সাংবাদিক। তারপর হলাম কবি ও শিক্ষক। তার পরে কবি-শিক্ষক ও শিক্ষক-প্রশিক্ষক। একসময় এর সবগুলো দক্ষতা নিংড়ে নিজের অজান্তেই হয়ে গেছি এক গল্পদিদি।
আমার দেশান্তরি জীবনের জীবিকার শুরু ১৯৯০ সালে, লন্ডনের সরকারি প্রাইমারি স্কুল টমাস বাক্সটনে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমি কমনলি দেশে লেখালেখি ও বিদেশে শিল্পচর্চার চারিণী কিছুটা। দেশের জ্ঞানের হাঁড়ির তলায় বসা সরটুকুও চেঁছে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কবিত্বের প্রাণ গামছা দিয়ে বাঁধতে পারিনি। সে কেবল কবি হতে চায়, লেখক হতে চায়, লিখেই উপার্জন করতে চায়। স্কুলের হেড বা ডেপুটি হতে চায় না। এদিকে যে বিলেতের বাড়িতে মেঝে মুছে আয় করতে চাইলেও পড়া লাগে, পরীক্ষা পাস লাগে, সনদ লাগে। তাই কাজের সমান্তরাল সময়েই ফাঁকে ফাঁকে রাত জেগে পড়াশোনা করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোয়েট অ্যান্ড স্টোরিটেলার ইন এডুকেশনে স্নাতক করলাম। জানলাম, এ দেশে সব শিল্প বা সৃজনবিদ্যাই সামাজিক শুশ্রূষা মাথায় রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু ‘এলাম দেখলাম জয় করলামের’ মতো হয়নি গো! বিয়াল্লিশ- পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে তা হলো পশ্চাতের খাল-বাকল তুলে ঘষটাতে ঘষটাতে। সন্তান ঈশিতা, সজীব ও কমরেড আজাদের সাহায্য ও ভালোবাসায়।
শিখলাম, এক মাঠ মানুষকে নিয়ে কিভাবে সাঁতরে পেরোতে হয় পূর্ণিমা পুকুর, টয়লেটের আউটলেটকে টঙ ও অলেখাকে লেখা করা যায় আর কিভাবে রোগ থেকে রোদন উঠিয়ে মানুষকে খানিক অব্যাহতি দেওয়া যায়। সনদ পাওয়ামাত্রই স্কুলে পড়ানোর কাজ কমাতে কমাতে একসময় ছেড়ে দিয়ে স্বপ্নের ‘রাইটার’ হলাম। সৃষ্টিশীলতাই হলো জীবিকা।
একটা সত্য কথা এই যে বিগত চৌত্রিশ বছরে বাংলাদেশ নিয়ে বিলেতে যত বক্তৃতা, পরামর্শদান, লেখা, আলোচনা, কবিতা পারফরম্যান্স, গল্প বলা করেছি, তা দেশে করতে গেলে দলবাজি-তেলাঞ্জলি না করলে পারতাম না।
আমার আদি ঠিকানা বাংলাদেশের সিলেটের মনুগাঙ। সিলেটি কইন্যা আমি। কিন্তু জন্মক্ষণে আমার মা ছিলেন ব্রহ্মপুত্রের ঘাটে। তাই ময়মনসিংহের মনোহর হাওয়ায় পুষ্ট হয়েছি আর বাবার চাকরিসূত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে পেয়েছি দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সৌরভ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় ছিলাম বলে বাংলাদেশ নির্মাণ-নৃতত্ত্বের আঁশে আঁশে ছিলাম আমিও। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর প্রবাসে ভিনভাষায় বাংলা ও বাংলাদেশের কথা, কবিতা ও গল্প বলে ও লিখে চলেছি নিরন্তর। বল-ভরসা ছিল বঙ্গজন্মেই। যেমন লিপিবদ্ধতার আগেও হোমারের কাহিনি ছিল, কাহ্নর মতো শ্লোক ছিল। কিন্তু কে আর অতীতের খোঁজে হাঁটে? একটি ভাষা বিশ্বস্ততার সঙ্গে উপলব্ধিতে গ্রথিত করলে তা ভাঙিয়েই পাড়ি দেওয়া যায় তেপান্তর। জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষাবীজই অভিবাসীর প্রথম বপন। তা থেকেই জীবনপ্রবাহ। সমভাষীদের মধ্যে ভাষা হাঁটে একভাবে, সংকরপ্রবাহে ভিন্নভাবে। সাধারণ মানুষই এর প্রাকৃত ধারা রাখে অব্যাহত। তাই হয় জনগণের ভাষা, প্রান্তজনের সখা।
আমি এখন নিজ জন্মভূমে পরবাসী—নোম্যাড। সালমান রুশদি বা অরুন্ধতী রায় নই বলে, বাংলা ভাষাটাই একমাত্র আপনার বলেই আমি নিজেই আমার মাখন গলানোর পদ্ধতি বের করেছি। বুঝে গেছি, ওই আমাদের ঠিকুজি। তাই ছুটি এলেই বিলেতের অর্জন ঢেলে দিতে দেশে যাই। তরুণ-তরুণীদের শিল্প ক্লাস নিই, তরুণ শিক্ষকদের বিলেতে যা শিখেছি তা উজাড় করে উজ্জীবিত হয়ে লন্ডনে ফিরি।
এখানে ইংরেজি লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা। আমার লেখার মূল ভাষা বাংলা। এ দেশে সারাক্ষণই বাইরে ভিনভাষা বললেও মনে মনে বলে চলেছি বাংলা ভাষা। এই থাকা না-থাকার কালে যা কিছু শূন্যস্থান তা ডায়াস্পোরার কুটো, কষ, ফুল, ফসফরাস ও লবঙ্গে ভরে ফেলেছি। ঠিক দুই শ বছর আগে এরা যেমন করেছিল, তেমনি আমি লুট করা কাঁচামাল দিয়েই নিজেকে নতুন করে নির্মাণ করেছি। নিজের কানকেই করছি কলিজা। এ নিয়ে আমাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের মিল না থাকতে পারে, কিন্তু লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য বুঝেই ভাষার প্রায়োগিক রূপ নিশ্চিত করেছি। আমি যেদিন দেশান্তরি হই, তখন আমার মাতৃভাষায়ই জ্ঞাত ছিলাম তাবৎ পৃথিবীর তরিবত। সে বোধই ভাঙিয়ে মেখেছি, খেয়েছি, পান করেছি, দুঃখ দিয়েছি, দুঃখ পেয়েছি। সবই এক ও অনন্য বাংলা থেকে ভাষান্তরে, তার নানাবিধ ব্যবহারে, বহুবিধ প্রক্রিয়ায়। আমি করেছি গদ্য ও পদ্যে, কবিতা ও কানুনে, স্টোরিটেলিং ও স্টোরিরাইটিংয়ে, পারফরম্যান্স ও পিকেটিংয়ে, শিক্ষকতা ও সৃজনশীলতায়, নাটক লেখা ও দেখায়, উপস্থাপনা ও নির্দেশনায়, বাংলা ও ইংরেজিতে এবং আঞ্চলিক সিলেটিতে। ভাষার যাত্রাগুলোকে একটি পথে মিলিয়ে নেওয়ার কাজ করার কথা আমাদেরই। আসলে মাতৃভাষাটা মননে জাগিয়ে রাখলে যতটা যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে, ঠিক ততটাই যাওয়া যায়। বাংলাদেশ বসবাসের চল্লিশ আর বিদেশের ত্রিশ বছর মিলে সত্তর বছর পর মনে হয় বাংলা মাধ্যমে বাংলা ভাষায় বিদ্যাশিক্ষা করে শুধু মাতৃভাষা সম্বল করেই বেরিয়ে পড়েছিলাম! কিন্তু তা-ও তো কম কিছু পাইনি।
বিলেতে আমার গুরু মাইকেল রোজেন, ওয়েন্ডি কোপ, স্যালি পম ক্লেইটন, বেঞ্জামিন জাফানায়ারা, হেলেন ইস্ট—এঁরা। আমি তাঁদের বিদ্যাকে তাবিজ করে তবলা বাজাতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু যেহেতু আমি সালমান রুশদি বা রঞ্জনা অ্যাশ না, পার্লামেন্ট থেকে আমি বহুদূরে পেভমেন্টে বসবাস আমার, তাই যেকোনো রকমের ছোটখাটো ফুটফরমাশও আনন্দের সঙ্গেই করেছি। তবু তো আর্টস করে খাচ্ছি! মনের মাইকে মুখ রেখে বলেছি, ‘শামীম, তুমি শুধু লিখে যাও, শব্দ দিয়েই বিস্কুট কিনতে পারবে, ইংল্যান্ডে এদেরই লিঙ্গুয়া ফ্রাংকাতেই নিজ শিল্প করতে করতে একদিন নাদের আলী তোমাকেও তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবে।’
আমার প্রথম এজেন্ট ছিল অ্যাপল অ্যান্ড স্নেইকস (সুন্দর নাম না?)। এখান থেকেই কাজ পেতাম। আমাকে বিদ্যালয়, ফেস্টিভাল, ওল্ড হোম, হাসপাতাল, কমিউনিটি হল, লাইব্রেরি, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—কোথায় না কোথায় ওরা পাঠাতে থাকল ভাবতে পারবেন না! সেসব জায়গায় খিদে পেলে কখনো অর্গানিক আহার, কখনো কড়া হালুয়া, কখনো শুধু সুন্দর বুদবুদ পানীয় পাই। কখনো উপস্থাপনা উপাচারের সঙ্গে কাঁধের ঝোলার মধ্যে করে নিয়ে যাই কলা। আর দম ফুরিয়ে এলে উইম্বল্ডন টেনিস মাঠের খেলোয়াড়দের মতো এক কামড় কলা গিলে বাকিটা তার ত্বকেই পেঁচিয়ে পরের বারের জন্য ভরে রাখি। লাঞ্চবক্স লাগেনি। আজ ভাবতে অবাক লাগছে, সেই আমি অ্যাপলসের কবি হিসেবেই লাভ করলাম বিলেতের জাতীয় সংগঠন ন্যাশনাল লটারি পুরস্কার। সারা বিলেত থেকে তেরো জনকে দিল ‘আর্ট ইন দ্য কমিউনিটি অ্যাওয়ার্ড’! আমি তার একজন! বলেন ‘অবিশ্বাস্য!’
কী করে এত দূর এলাম? কখনো নিগৃহীতের মতো বাথরুমের পাশে নড়বড়ে কোনো এক চেয়ারে বসে একটা টেবিল জোগাড় করে মুখে মেগাফোন লাগিয়ে ‘এই গল্প গল্প গল্প...মাইছা মাইছা মাইছা...স্টোরি স্টোরি স্টোরি...’ হেঁকে হেঁকে দর্শক জোটাতে হয়েছে। আড় ভেঙে দিয়েছেন স্যালি পম ক্লেইটন। কখনো শুধু আমার কারণে বাংলাদেশের নামটি কাগজে ছাপবে বলেই বেহায়ার মতো লটকে থেকেছি। কলিজার থোড় থেকে প্রাণ উগরে দিয়ে কাজগুলো করার শিক্ষা পেয়েছি। এতে করতালি থেকে কখনো অনন্য মন বিবাগী করা বেহেশতও পেয়েছি।
সে রকমই একদিনের কথা বলছি।
গল্প বলার কাজ ছিল বিলেতে প্রথম স্থাপিত বিশ্ববিখ্যাত শিশু হাসপাতাল গ্রেট অরম্যান্ড স্ট্রিট হাসপাতালের ক্যান্সার বিভাগে। এই হাসপাতালেই রুগ্ণ শিশুদের জন্য ১৯২৯ পিটার প্যানের লেখক জিম ব্যারি তাঁর বই ও নাটকের সর্বস্বত্ব দান করে দিয়ে গেছেন। তখন থেকেই তারা এখানের শিশুদের শিল্প দিয়ে সেবার চেষ্টা করে আসছে।
এজেন্সির সুবর্ণ সুন্দরী ডেইজী হাসপাতালের করিডর থেকে বিদায় নিতেই সামনে তাকিয়ে মনে হলো, আমি এক অবিস্মরণীয় আনন্দ-উদ্যানে এসে পড়েছি। হালকা মিউজিক হচ্ছে। চারদিকে মিষ্টি রঙের দেয়ালচিত্র আর খাবারের রঙে ছোট ছোট চেয়ার-টেবিল। এ শিশুদের ক্যাফে। কোনো শিশু ইন্ট্রাভেনাস নিয়ে হাঁটছে, কেউ গলায় ব্যান্ডেজ নিয়ে খাবার নাড়ছে, কেউ বা চিৎকার করছে ব্যথায়, কেউ আবার মাকে ধমকাচ্ছে কেন তাকে তার প্রিয় ফিশ অ্যান্ড চিপস দিচ্ছে না। চারদিকে পরির মতো সাদা নীল জামা পরা মমতাময়ী নার্সরা এই শিশুরাজ্যে শিশুদের আর্তনাদ মমতা দিয়েই, সেবা দিয়েই কষ্ট কমিয়ে দিচ্ছেন।
আমি ছয় বছর আর আট বছরের দুজন শিশুকে গল্প বলতে গেছি। অন্ত্রে অস্ত্রোপচারের পর দুজন একই ওয়ার্ডে আছে। তাদের চুলের রং মুখের রেখা আর নেতিয়ে পড়া বাহু যুগলের কথা এত দিন পরও স্পষ্ট মনে আছে। গভীর ক্লান্তিতে ডুবে আছে তাদের নরম চোখ। হাসি বিষণ্ন ও মলিন। একজনের আইভি লাগানো, কিন্তু অন্য হাতে বুকে জড়িয়ে রেখেছে উলের ডলফিন। নিজেদের অবস্থা নিজেরাই বলল। ডাক্তারি যন্ত্রপাতিতে এরই মধ্যে তারা বিশেষজ্ঞ। দুই মিনিটেই অবসন্ন স্বরে ভাগাভাগি করে বলে দিল তাদের রোগ সারাতে এই মেশিনগুলোর অসাধারণ ভূমিকার কথা।
‘কিমো নিলে শামীম, প্রথমে তোমার একটু কষ্ট হবে, বমি বমি লাগবে; কিন্তু তার পরই তুমি চিলড্রেনস প্লেগ্রাউন্ডে খেলার মতো শক্তি পেয়ে যাবে।’ আহা রে...। হায় শিশু, হায় সোনালি শিশু, কী কারণে তোমার এত কষ্ট! যদিও ঈশ্বর সব মঙ্গলের নিমিত্তেই করেন, তবু কেন ফিলিস্তিনে এত শিশুর মৃত্যু? এগুলো দেখা কার দায়িত্ব?
ওদের দুজনের বিছানার মাঝামাঝি এক চেয়ারে বসলাম। ঝোলার মধ্যে ছিল আমার গল্পের চরিত্রের একটি প্লাস্টিক খেজুরগাছ, একটি সাদা-কালো গাভি আর একটি মিনি নকশিকাঁথা। গল্প বলছিলাম থেকে থেকে, থেমে থেমে, নার্স বা তাদের মা তাদের পরিচর্যা করার ফাঁকে ফাঁকে। একজন শুনতে শুনতে বলল, ‘আই অ্যাম টায়ার্ড, আরেক দিন বাকিটা শুনব।’ আরেকজন ঘুমিয়ে পড়ল। আমি উঠে অন্য ওয়ার্ডে যাওয়ার আগে পেছন ফিরে দেখি, শিশুটি মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদছে। মা কৃতজ্ঞ চোখের আর্তি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। জানতে চান, ‘আমি কি ফিরে আসব? থ্যাংক্যু, শামীম।’ আহা রে...মা—যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিক্ষুক। এ কথা লেখার পর বাংলাদেশের আর্যর মায়ের কথা মনে হচ্ছে, যে সন্তানের চিকিৎসার জন্য সর্বহারা হয়ে বিদেশে পড়ে আছে।
আমি বাংলাদেশের এক অতি ক্ষুদ্র কবি, নগণ্য এক গল্পদিদি। কী-ই বা আমার সামর্থ্য? জানি তো মৃত্যুই ধ্রুব, আর কোনো কিছু স্থায়ী না। মহাকালের এই সংক্ষিপ্ত সময়ে আমি দাতা নই, গ্রহীতা নিত্যানন্দের। এই অ্যাত্তটুকু করে আমি আমার সৃজন সংসারে এমন অবিস্মরণীয় উপহার পাইলাম? এইতো মনবিবাগী বেহেশত আমার।
সম্পর্কিত খবর
বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’
কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।
মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।
‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’
প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।
‘দেখান তো ভাই।’
র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।
লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।
‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’
নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।
মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!
লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’
লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!
তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?
পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।
‘কী করছ, বাবা?’
‘এইতো—দোকানে বসছি।’
‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’
‘কেন?’
‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’
‘খুব দরকার?’
‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’
‘দেখি।’
‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’
লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।
মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’
বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।
এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।
দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।
মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।
এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।
‘তুমি!’
যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।
মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’
‘আসো।’
দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’
নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’
‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’
‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’
‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’
‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’
নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।
মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’
নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’
মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’
নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’
‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’
নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’
এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’
নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।
নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।
নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’
নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’
এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।
নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’
হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’
মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’
‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’
‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’
নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।
বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’
‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’
‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’
মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!
নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’
মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’
নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’
নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।
পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।
স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।
মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!
হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।
গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!
মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।
ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।
রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!
রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।
ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?
রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।
ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?
রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!
ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!
রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!
ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।
রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।
ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—
রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।
লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।
খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।
ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।
তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?
রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।
ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?
রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—
ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?
রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!
ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?
রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!
ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।
অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?
ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।
রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!
রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?
রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?
ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!
রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?
ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...
রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!
ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!
রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।
ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না!
সকালে হালকা সাজ
সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।
সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।
দুপুরে চাই আরাম
গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’
রাতে জমকালো
রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’
যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।
পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।
বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।
প্রিন্টে পরিপাটি
প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।
কাটছাঁটে নতুন কী
গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’
একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।
কখন কেমন পাঞ্জাবি
ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।
কোথায় পাবেন, কেমন দাম
বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।