শেষে বলল, ‘নদীদূষণের শেষ পরিণতি হলো সমুদ্রদূষণ। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি শহর কোনো না কোনো নদীর তীরে অবস্থিত। যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক বোতল ও ব্যাগের বড় একটি অংশ প্রথমে আশপাশের নর্দমায় যায়, তারপর সেগুলো নর্দমার পানিতে ভাসতে ভাসতে নদী-নালা হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। মাছ ধরার নৌকা আর জাহাজ থেকেও সমুদ্রে প্লাস্টিক ফেলা হয়। এভাবে প্রতিবছর আনুমানিক ১৪ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে আসে। অথচ সমুদ্রের রয়েছে বিশাল সম্পদ, নিজেদের প্রয়োজনেই ওই সম্পদ মানুষের রক্ষা করা দরকার। কেন যে বোঝে না!’
সমুদ্রের কথা শুনে গাছ বলল, ‘বুঝলে তো গাছেরও ক্ষতি করত না মানুষ। পৃথিবীতে প্রতিদিন কত গাছ কাটা হচ্ছে জানো? প্রায় ৪২ মিলিয়ন। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখতে গাছপালার ভূমিকা অনেক। পৃথিবীতে গাছ না থাকলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, অক্সিজেন, ওষুধ মানুষ কোথা থেকে পেত? প্রাণিজগতের জীবন বাঁচাতেও গাছের দরকার। আর মানুষ কিনা সেই গাছ কেটে বিনাশ করে ফেলছে।’
অরণ্য চোখ বুজে শুনছিল। সবাই ভেবেছে বুঝি ঘুমাচ্ছে। কিন্তু না! আচমকা চোখ মেলে বলল, ‘জ্বালানি কাঠ, কাঠ, কাঠের সজ্জা, মধু, ঔষধি গাছ, ভেষজ, জৈবসারসহ আরো কত কিছু মানুষ অরণ্য থেকে পায়। সেই অরণ্যও ধ্বংস করছে তারা। মানুষ যদি এখনই অরণ্য বাঁচানোর ব্যবস্থা না নেয়, তবে জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির ক্ষয়, বায়ুদূষণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয় এমন অনেক ক্ষতির কারণ হবে অরণ্য।’
এবার বিরতি। বিরতিতে খানাদানা আর গান-বাজনা হলো। পাহাড় আবৃত্তি করে শোনাল। গান-বাজনার মতো আবৃত্তিটাও ভারি সুন্দর ছিল। বিরতি শেষে পাহাড় ফের শুরু করল, ‘মানুষ অরণ্য আর গাছপালার সর্বনাশ করছে বলে তো পাহাড়ও ধসে যাচ্ছে। অথচ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পাহাড়ের গুরুত্ব অনেক মানুষ সেটা জানে, বুঝেও; তবু তারা পাহাড় কেটে বসতি বানাচ্ছে।’
এত অভিযোগ শুনে শুনেও আকাশের বুকে চাঁদ হাসছে। আকাশ চুপ করে আছে দেখে পাখি বলল, ‘তুমি দেখি কিছুই বলছ না, আকাশ! নদী নষ্ট, গাছ কাটা, সমুদ্রদূষণ, অরণ্য ধ্বংস, পাহাড় ধস নিয়ে মানুষের প্রতি ওদের কত অভিযোগ, অভিমান। তুমিও কিছু বলো।’
আকাশ বলল, ‘ওদের প্রতি মানুষের অনাদর, অবহেলা দেখে দূর থেকে আমিও কষ্ট পাই ঠিক, তবে আমার নিজের জন্য তেমন কোনো কষ্ট নেই। পাহাড়, নদী, অরণ্যরা মানুষের কাছে আছে। তাই মানুষ ওদের কষ্ট দিতে পারে। আমি থাকি অনেক দূরে। মানুষ না পারে আমায় ছুঁতে, না পারে কষ্ট দিতে। ঠিক কি না, পাখি?’
চাঁদের পানে এক ঝলক তাকিয়ে পাখি বলল, ‘যদিও এখানে আমি নদীর প্রতিনিধি, অতিথি; তবু বলতে চাই, মানুষ মহান, সৃষ্টির সেরা। এমন মানুষের সান্নিধ্যে তোমরা আছ, একি কম কথা! তোমাদের অভিযোগ অল্প কিছু বেকুব মানুষের প্রতি। বেশির ভাগ সচেতন মানুষ তোমাদের যত্ন নেয়, ভালোবাসে। নইলে কবে তোমরা বিলুপ্ত হয়ে যেতে! সেই সচেতন মানুষদের দেখে দেখে অন্যরাও একদিন তোমাদের মানে অরণ্যের যত্ন নিয়ে, পাহাড়ের যত্ন নিয়ে, নদী, সমুদ্র, গাছের যত্ন নিয়ে প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়ে তুলবে।’
পাখির কথা শুনে সবাই ভাবল, মানুষ তো পাখিকেও জ্বালায়, কষ্ট দেয় আবার মেরেও ফেলে! সেই পাখির মুখেই কিনা মানুষের জয়জয়কার! ভেবে ওরা আপ্লুত, উচ্ছ্বসিত, উৎসাহিত। তৎক্ষণাৎ নদীর ওপর খুশি হয়ে সমুদ্র নিজের থেকে একপেশে জল দিয়ে পাখিকে বলল, ‘নদীকে দিয়ো, বোলো এই জল তোমাকে পাঠানোর জন্য তাকে আমার উপহার।’
আকাশ, গাছ আর অরণ্যও মানুষের প্রশংসা করার জন্য পাখিকে উপহার দিল। উপহারের ছড়াছড়ি দেখে চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙে উছলে পড়ে আলো।