<article> <p style="text-align: justify;">১৪০ কোটি মানুষের দেশ এই ভারতবর্ষ। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ভৌগোলিক আয়তন। এহেন ভারতে লোকসভা নির্বাচন মানেই গোটা দেশে একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তো হয়েছিল ১৮ দিন মাত্র।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">আর এবারের লোকসভা নির্বাচন হবে তিন মাস ধরে। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফল জানা যাবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে সাত দফায় ভোট হবে। ২ জুন পশ্চিমবঙ্গে শেষ ভোট। আর গোটা দেশের ফলাফল বেরোবে ৬ জুন।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">নরেন্দ্র মোদি শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি এবারও অন্যান্যবারের মতো নির্বাচনের প্রধান দলীয় মুখ। প্রচারের বিষয়বস্তু মোদির গ্যারান্টি। হিন্দি বলয়ের দল বিজেপি।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">অর্থাৎ যেসব রাজ্যে হিন্দিভাষী মানুষের প্রাধান্য; যে রকম উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যগুলো, সেখানে বিজেপির সবচেয়ে বেশি দাপট। কিন্তু এবার পশ্চিমবঙ্গসহ পূর্ব ভারত আর দক্ষিণ ভারতে বিজেপি তার ক্ষমতা প্রসারিত করতে চাইছে। আরো বেশি আসন নিয়ে আসতে চাইছে। হয়তো বিজেপির অভ্যন্তরে একটা ধারণা আছে যে গতবারের নির্বাচনে হিন্দি বলয়ে বিজেপি সর্বাধিক আসন পেয়ে বসে আছে, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় স্যাচুরেটেড সিচুয়েশন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দিল্লিতে সাতটা লোকসভা আসনের সাতটাই বিজেপির।</p> </article> <article> <p style="text-align: justify;">ফলে হিন্দি বলয়ের বাইরে দক্ষিণ বলয় এবং পূর্ব ভারতে আসন বাড়ানোটা এবার একটা মস্ত বড় অগ্রাধিকার।</p> <p style="text-align: justify;">কিন্তু ভোটের সময় যেহেতু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি খুব বড় হয়ে ওঠে, তাই বলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি তো বন্ধ হয়ে থাকে না। একদিকে যেমন ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজ তুলে উগ্র হিন্দুত্ব বিজেপির একটা তুরুপের তাস, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর আবেগে প্রভাব বিস্তার করে অযোধ্যায় বালক রামের মন্দিরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, আবার রাম নবমীর দিন প্রধানমন্ত্রী নতুন উদ্যমে অযোধ্যার তাস ব্যবহার করবেন, এমনটাও সবার ধারণা। কিন্তু তাই বলে কি উন্নয়ন, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, বেকার সমস্যা, দারিদ্র্য, ধনী-গরিবের বৈষম্য—এই বিষয়গুলো অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? নরেন্দ্র মোদি গরিব মানুষের জন্য গৃহনির্মাণ থেকে শুরু করে বালিকাদের নানা রকমের প্রকল্প, স্কুলছাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা—এসব করে শুধু ধনী অভিজাত নয়, গরিব মানুষের কাছেও পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।</p> <p style="text-align: justify;">সমস্যা হচ্ছে, পৃথিবীজুড়েই ধনী ও দরিদ্রের আর্থিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। বিভিন্ন রিপোর্ট আসছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে, যেগুলো নরেন্দ্র মোদির জন্য সুখকর হচ্ছে না। যেমন—সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা নিয়ে স্পেনের একটি আর্থিক সংস্থার রিপোর্ট বেশ অস্বস্তিকরই বটে। তারা বলছে, গোটা পৃথিবীতে গণতন্ত্রের প্রশ্নে ভারত অনেক পিছিয়ে গেছে। সমস্যা হচ্ছে, আর্থিক অসাম্যটা গোটা পৃথিবীতে যে সমস্যার সৃষ্টি করছে, সেখানে ভারতেরও শেয়ারবাজার যতই উত্থিত হোক, বেকারি, কর্মহীনতা, দারিদ্র্যের সমস্যা কিন্তু ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। নরেন্দ্র মোদি যদি আবার ক্ষমতায় আসেন, যেমনটা অনেকেই মনে করছে, তাতে কিন্তু এই আর্থিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার না দিলে বিপদ। আর সে কারণেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, এই ভোটের মৌসুমেই নিউজ ইন পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি আগ্রহী। আর চীনও সেই ব্যাপারে সদর্থক মতামত জানিয়েছে। কারণ নাকি একটাই, ভারতের আর্থিক উন্নয়নের পথে যদি হাঁটতে হয়, তাহলে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে বাণিজ্য সম্পর্কে আরো অগ্রসরতার পথে যেতে হবে। তা না হলে বিপদ। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়েও খুব সমস্যা। মালদ্বীপ তো খুব জটিল হয়েই গেছে। পাশাপাশি অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে ভুটান—এসব দেশ নিয়ে ভারত উদ্বিগ্ন। কেননা চীন সেখানে খুব দ্রুত প্রভাব বিস্তার করছে।</p> <p style="text-align: justify;">এই পরিস্থিতিতে ন্যাটোর সদস্য না হয়েও ভারত যদি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের দোসর হয়ে থাকে, তবে সেটা আর যা-ই হোক, খুব ভালো কূটনীতি নয়। আর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টা কিন্তু এখন ভোটের মৌসুমেও ইস্যু হচ্ছে। কংগ্রেস নেতারা চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।</p> <p style="text-align: justify;">আবার ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেও নির্বাচন আসন্ন। সেখানে বাইডেন চলে গিয়ে ট্রাম্প আসতে পারেন আবার ক্ষমতায়—এমনটা নানা সমীক্ষা বলছে। আবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনেক মামলা-মোকদ্দমা চলছে। সেগুলো আরো বাড়বে। সুতরাং শেষ পর্যন্ত কী হবে, সেটা দেখার জন্য ভারত অপেক্ষা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখাটা খুব জরুরি। তার কারণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও ভারতের ব্যবসা এবং বিনিয়োগ প্রয়োজন। ইলন মাস্ক  শিগগিরই দিল্লিতে আসছেন। টেসলার বিরাট বিনিয়োগ হবে এমনটা মনে করা হচ্ছে। অটোমোবাইল শিল্প ভারতে খুব খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। সেগুলো অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশনের রিপোর্ট থেকেও জানা যাচ্ছে। এদিকে কৃত্রিম মেধার ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল এই মুহূর্তে ভারত। ইলন মাস্কও বারবার বলছেন, কৃত্রিম মেধার বিনিয়োগ ভয়ংকর বাড়বে। এর পাশাপাশি লন্ডনেও ইউরোপীয় সংসদের নির্বাচন আসন্ন। সেখানে শাসকদল ভালো ফল না-ও করতে পারে এবং ব্রিটেনের আর্থিক সংকটে প্রধানমন্ত্রী জেরবার। রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কোনো কারণে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফলাফল খারাপ হলে লন্ডনে সরকার পতন হবে কি না, তাড়াতাড়ি নির্বাচন এগিয়ে আসবে কি না—এসব প্রশ্নও রয়েছে। আর যখন ভারতের নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্যস্ত, তখন লন্ডনের ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেবার পার্টির, তিনি যোগাযোগ করছেন ভারতের সঙ্গে। আগাম ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক করার চেষ্টা করছেন, যদিও শেষ পর্যন্ত ব্রিটেনে ভোটের ফলাফল কী হবে, কেউ জানে না। ফলে পরিস্থিতি চারদিক থেকে জটিল। ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এত ভালো সম্পর্ক ছিল, কিন্তু এখন ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যুদ্ধবিরতি না করার সিদ্ধান্ত, সেটাতে যুক্তরাষ্ট্র আবার খুশি নয়।</p> <p style="text-align: justify;">এই পরিস্থিতিতে নাগরিকত্ব বিল, রামমন্দির, কাশ্মীর—এগুলো যেমন একদিকে ভোটের ইস্যু, আবার আন্তর্জাতিক চাপও বাড়ছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী আবার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে যে শিগগিরই কাশ্মীরে নির্বাচন হবে। নির্বাচিত সরকার আবার কাশ্মীরে মোতায়েন হবে। ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত হলে কী হবে, কাশ্মীরে গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করবেন নরেন্দ্র মোদি। কেন এবারের ভোটের সঙ্গে কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচন হলো না, সেই প্রশ্ন বিরোধীরা তুলছেন। সেটাও কিন্তু এবারের ভোটের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কাজেই সব মিলিয়ে পরিস্থিতিটা জটিল হয়ে উঠেছে। বিশ্বকূটনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষা করাটা কঠিন কাজ। যেমন—নাগরিকত্ব বিলটা যে রকম অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এই আইনের জন্য কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করার জন্য সমালোচনার মুখে পড়ছেন নরেন্দ্র মোদি। আর এই ভারসাম্য রক্ষার কূটনীতিটা, রাজনীতিটা  বিজেপি বা অমিত শাহকে করতে হচ্ছে না। তাঁরা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়েই ব্যস্ত। এই ভারসাম্য রক্ষার কাজটা কিন্তু করতে হচ্ছে নরেন্দ্র মোদিকে। কেননা ভোট আসবে, ভোট যাবে। কিন্তু দেশ চালানোর দায়িত্বটা যদি নরেন্দ্র মোদির কাঁধেই আবার আসে, তখন আজকের এই সমস্যাগুলোই মহীরুহ হয়ে দাঁড়াবে, যেগুলো আজকে ছোট চারাগাছ হয়ে রয়েছে। আর যা-ই হোক, বিষবৃক্ষ বপন করতে চান না নরেন্দ্র মোদি।</p> <p style="text-align: justify;"><strong>লেখক : </strong>নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি</p> </article>