<p>ক্ষুদ্র ব্যবসার পাশাপাশি সম্প্রতি বাড়িতে দুটি ছাগল ও কয়েকটি মুরগি পালন শুরু করেছেন ঢাকার সাভারের শ্যামলাসী এলাকার বাসিন্দা মো. হাসান। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই একটি ছাগলের নাক দিয়ে পানি পড়তে শুরু করলে এক প্রতিবেশীর পরামর্শে ফার্মেসি থেকে নাপা ট্যাবলেট কিনে ছাগলটিকে খাইয়ে দেন হাসান। ওই এলাকার অনেকেই নিজেদের পালিত গবাদি পশুপাখির অসুখ-বিসুখে মানুষের জন্য উৎপাদিত ওষুধ কিনে খাওয়ায়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এমন দৃশ্য চোখে পড়ে হরহামেশাই।</p> <p>অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাঁস-মুরগির জ্বর বা রানীক্ষেত রোগ হলে মানুষের জন্য উৎপাদিত প্যারাসিটামলজাতীয় ট্যাবলেট গুঁড়া করে গরম ভাতের সঙ্গে খাওয়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া গরু-ছাগলের পেটের সমস্যায় খাওয়ানো হয় অ্যামোডিস-মেট্রো জাতীয় ওষুধ, জ্বর-ঠাণ্ডার জন্য সিপ্রোসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশা। গবাদি পশুর শরীর ফোলা কমানোর জন্য খাওয়ানো হচ্ছে ফুসিড-৪০ নামের একটি ওষুধ, পশুকে মোটাতাজাকরণের জন্য খাওয়ানো হচ্ছে ডেক্সামেথাসন, পশু ব্যথা পেলে খাওয়ানো হচ্ছে ডাইক্লোফেনাকজাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ। এ ছাড়া টেট্রাসাইক্লিন, জিংক, ভিটামিনসহ আরো কয়েক প্রকার ওষুধ পশুপাখিকে খাওয়ানো হচ্ছে, যেগুলো উৎপাদিত হয়েছে মানবদেহের জন্য।  পশুপাখিকে এসব ওষুধ খাওয়ানো হয় মানুষের দ্বিগুণ ডোজ।</p> <p>ওষুধ বিশেষজ্ঞদের মতে, নীতিগতভাবে এটা কোনোভাবেই ঠিক নয়। তাঁদের মতে, মানুষের ওষুধ পশুপাখিকে খাওয়ালে তাত্ক্ষণিকভাবে উপকার মিলতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।</p> <p>পশু চিকিৎসকদের দাবি, তাঁরা কখনোই মানুষের ওষুধ পশুর জন্য সাজেস্ট করেন না। কিছু হাতুড়ে চিকিৎসক এই কাজ করে থাকেন। এ ছাড়া সাধারণ মানুষ একজন আরেকজনের কাছে শুনে শুনে এমন চিকিৎসা পদ্ধতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। তাঁরা বলছেন, মানুষের ওষুধ তৈরি হয় মানবদেহের ফর্মুলেশন অনুযায়ী। তাই মানবদেহের জন্য তৈরি ওষুধ গবাদি পশুকে খাওয়নো ঠিক নয়। আর পশুর চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক উপজেলায়ই পশু হাসপাতাল রয়েছে। সে জন্য নিজে বা হাতুড়ে চিকিৎসকের কথায় গবাদি পশুপাখি চিকিৎসা না করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।</p> <p>বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৈমুর ইসলাম বলেন, মানবদেহের জন্য অনুমোদিত ওষুধগুলো গবাদি পশুকে সাধারণত খাওয়ানো হয় না। এর পরও অনেক সময়ই সহজলভ্যতার কারণে কিছু কিছু ওষুধ গবাদি পশুকে বিশেষ করে পোষা প্রাণী ও পাখিকে খাওয়ায় সাধারণ মানুষ। ক্ষুদ্র খামারি কিংবা যারা বাড়িতে অল্প পরিসরে গবাদি পশুপাখি ও পোষা প্রাণী লালন-পালন করে তারাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই কাজ করে। তবে এতে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। কারণ মানবদেহের জন্য অনুমোদিত ওষুধগুলো অনেক বেশি বিশুদ্ধ ও হাইজেনিক উপায়ে উৎপাদন করা হয়।</p> <p>বাংলাদেশ ভেটেরিনারি কাউন্সিলের সভাপতি ডা. মো. মনজুর কাদির বলেন, ‘মানুষের ওষুধ গবাদি পশুকে খাওয়ানো ঠিক নয়। তবে এ বিষয়ে সচেতন নয় সাধারণ মানুষ। ঈদুল আজহার আগে কেরানীগঞ্জ থেকে আমাদের কাছে এমন একটি অভিযোগ এসেছিল। এ ঘটনায় আমরা জরিমানা করেছি।’</p> <p>ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, ‘মানবদেহের জন্য উৎপাদিত ওষুধ পশুপাখিকে খাওয়ানোর নিয়ম নেই, কখনোই এটা ঠিক নয়। এ কারণেই আমরা মানুষ ও পশুপাখির জন্য আলাদা ওষুধের রেজিস্ট্রেশন দিই। মানবদেহের ওষুধে যদি পশুপাখিরও কাজ হতো তাহলে তো তাদের জন্য আলাদা ওষুধ উৎপাদনের প্রয়োজন হতো না। মানুষের ওষুধ পশুকে খাওয়ানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’</p> <p>প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, ‘মানবদেহের জন্য উৎপাদিত ওষুধ পশুপাখিকে খাওয়ানো নীতিগতভাবে ঠিক নয়, কারণ তাদের জন্যও আলাদা ওষুধ রয়েছে। কিন্তু খাওয়ালে তেমন কোনো সমস্যা নেই। এ ছাড়া আমরাও বর্তমানে সিপ্রোসিনজাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক পশুপাখিকে খাওয়ানোর বিষয়ে সাধারণ মানুষকে নিরুৎসাহ করছি।’</p> <p>এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এবং ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক (অব.) আ ব ম ফারুক বলেন, ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ভুল কথা বলেছে। শুধু নীতিগতভাবেই নয়, বৈজ্ঞানিকভাবেও মানুষের জন্য অনুমোদিত ওষুধ গবাদি পশুকে খাওয়ানো ঠিক নয়। গবাদি পশুর শরীরে জীবাণুর কারণে যে অসুখ হবে, তার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে যেটা হচ্ছে মানুষের জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ দিয়ে প্রাণীর চিকিৎসা করা হচ্ছে। এটা মানবতাবিরোধী ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ ছাড়া ২০১০ সালে প্রণীত মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইনেও এ বিষয়ে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু এখন সেটাই করা হচ্ছে।’</p> <p>যেসব পশুকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হচ্ছে, সেই পশুর রক্তের সংস্পর্শে, পশুর সংস্পর্শে মানুষও সংক্রমিত হতে পারে। আরেকটা বিষয় হলো, যেসব পশুর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স জীবাণু তৈরি হয়েছে, তারা যে মল ত্যাগ করছে, সেগুলো পরিবেশের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে এবং সেখান থেকে অন্যান্য জিন ট্রান্সফরমেশন ঘটছে। এভাবে একটা মহামারির ব্যাপার নীরবে ঘটে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা টের পাচ্ছি না।’</p> <p>অধ্যাপক ফারুক বলেন, ‘আমরা সে কারণে বলছি দুধ, মাছ, মাংস যাই খাই না কেন, এগুলোর মধ্যে সামান্য পরিমাণে অ্যান্টিবায়োটিক চলে আসছে। ফলে প্রধান ঝুঁকিটা হলো মানুষও ওই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি দ্রুত এই অপরাধ বন্ধ না করি, তাহলে একটা সময় আসবে যখন অতি সাধারণ সংক্রমণে মানুষ মারা যাবে। সাইকেল থেকে পড়ে হাত-পা কেটে গেলেও আমরা তার চিকিৎসা করতে পারব না। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকেই সেই ঘা আর শুকাবে না। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে ২০১০ সালে প্রণীত মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন মানতে হবে, মানাতে হবে। যারা আইন মানবে না তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।</p> <p> </p> <p> </p>