<p>আরো চাপে পড়তে যাচ্ছে অর্থনীতি। গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে প্রবাস আয় বা রেমিট্যান্স কমেছে ৭.৯ শতাংশ। আট মাসের মধ্যে এটা সর্বনিম্ন। পাশাপাশি এ মাসে রপ্তানি আয়ও কমেছে। আর জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কমেছে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ের পরিমাণও। একমাত্র জনশক্তি রপ্তানির সূচক এখনো ইতিবাচক আছে।</p> <p>রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক সহায়তা আরো সংকুচিত হওয়ায় ডলারের সংকট আরো দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় আমদানিতে যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি ডলার ব্যয় করতে হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের বিপরীতে আমদানি ব্যয় অনেক বাড়ায় কয়েক মাস ধরে বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা চলছে। কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও।</p> <p>সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগামী এক বছর এই চাপ থাকবে, তাই আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় খুবই সতর্ক হতে হবে। মুদ্রা বিনিময় হারের কার্যকর ব্যবস্থাপনা বের করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘টাকা এখনো অতিমূল্যায়িত আছে। আমাদের রপ্তানিকারক ও প্রবাসীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা আগেই কিছুটা বাজারমুখী করা গেলে একবারে এই চাপ আসত না। সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা ও বৈদেশিক খাতের ব্যবস্থাপনা—এই দুটিকে সুষম ব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখতে হবে।’</p> <p><strong>রেমিট্যান্স</strong></p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৭.৯ শতাংশ। এ সময়ে দেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১.৫২ বিলিয়ন ডলার, আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১.৬৪ বিলিয়ন ডলার।</p> <p>প্রবাস আয় ও রপ্তানি আয়ে ডলারের দুই ধরনের দাম বেঁধে দেওয়ার কারণেও প্রবাস আয় আসার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। গত সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ডলারের আলাদা দর নির্ধারণ করার পর সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সে ধাক্কা আসে। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় প্রবাসী কর্মীরা হুন্ডিসহ অন্যান্য উৎস বেশি বিনিময়হার পাওয়ার কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমেছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।</p> <p>অর্থনীতিবিদরা জানান, জনশক্তি রপ্তানি বাড়লেও রেমিট্যান্স কমার প্রধান কারণ হুন্ডি। ব্যাংকগুলো এখন রেমিট্যান্সে সর্বোচ্চ ১০৭ টাকা দর দিচ্ছে। হুন্ডি কারবারিরা সেখানে দিচ্ছে ১১০ থেকে ১১২ টাকা পর্যন্ত। আবার কোনো ঝামেলা ছাড়াই প্রবাসীর কর্মস্থলে গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে তারা।</p> <p>ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাড়লেই যে প্রবাস আয় বাড়বে তা নয়। করোনার পর গত বছর আমাদের রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বিদেশ গেছে। তাতে প্রবাস আয় কিন্তু বাড়েনি। আমরা কী পরিমাণ দক্ষ কর্মী পাঠাতে পারছি সেটাই বড় কথা। কারণ অদক্ষ কর্মী পাঠালে তাদের ব্যয়ের টাকা তুলতেই কয়েক বছর লেগে যায়। সৌদি আরবের পর বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বড় বাজার সংযুক্ত আরব আমিরাত বন্ধ থাকা প্রবাস আয় কমার বড় কারণ।’</p> <p><strong>রপ্তানি আয়</strong></p> <p>অক্টোবরে রপ্তানি আয়ও কমে গেছে। এই মাসে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য অন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি হয়েছে, আগের বছরের অক্টোবরের তুলনায় যা ৩৭ কোটি ৯ লাখ ১০ হাজার ডলার বা ৭.৮৫ শতাংশ কম। ২০২১ সালের অক্টোবরে রপ্তানি হয়েছিল ৪৭২ কোটি ৭৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য।</p> <p>ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি সংকট ও ডলারের বিপরীতে ইউরোর দরপতনের কারণে ইউরোপে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানির প্রধান বাজার ইউরোপ। সেখান থেকে কমেছে পণ্য রপ্তানির ক্রয়াদেশ (অর্ডার)। আবার দেশে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে কারখানায় উৎপাদনও কমছে।</p> <p>রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের ফলে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান। তিনি বলেন, গত দুই মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমছে। গত সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ৭.৫২ শতাংশ। অক্টোবরেও রপ্তানি ২০ শতাংশ কম হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।</p> <p><strong>বৈদেশিক সহায়তা</strong></p> <p>অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় ৩০ শতাংশ কমেছে। এ সময়ে অর্থ ছাড় হয়েছে ১৩৪ কেটি ৯২ লাখ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থ ছাড় হয়েছিল ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার।</p> <p>বৈদেশিক অর্থছাড়ের কারণ হিসেবে গত অর্থবছরে করোনার টিকা সংগ্রহ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয়ের পাশাপাশি চলমান বৈশ্বিক সংকটকে দায়ী করছেন ইআরডির কর্মকর্তারা।</p> <p><strong>ডলারের উৎস টান</strong></p> <p>বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে রপ্তানি খাত, প্রবাস আয় এবং বৈদেশিক ঋণ, সহায়তা ও অনুদান। প্রবাস আয় ও রপ্তানি বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়ে, যা অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়ায়। শ্রীলঙ্কার সংকটে পড়ার কারণ হচ্ছে, দেশটির কাছে পণ্য আমদানি করার মতো এবং বৈদেশিক দেনা পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। পাকিস্তানও একই কারণে বিপাকে রয়েছে। তবে ভারতসহ কয়েকটি দেশ আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়ায় দক্ষতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।</p> <p>পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ একগুচ্ছ উদ্যোগ দিয়েছে। এতেও ডলারের সংকট কাটছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, রিজার্ভ কমার আশঙ্কায় প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য সব ধরনের পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। অন্য পণ্যের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এলসি মার্জিন আরোপ করায় এলসি পেমেন্ট ধীরে ধীরে কমে আসছে। এর পরও এখনো বাণিজ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। আমদানি ব্যয়ের চেয়ে রপ্তানি আয় কম হওয়ায় অর্থবছরের শুরুতেই বড় অঙ্কের এই বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।</p> <p><strong>৩৪ বিলিয়নে নামছে রিজার্ভ</strong></p> <p>ডলার সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই অর্থবছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ৪৮১ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়। গত অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৬২ কোটি ডলার।</p> <p>গত মঙ্গলবার দিনশেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৫.৭৯ বিলিয়ন ডলার। আগামী সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১.৫ বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ নেমে আসবে ৩৪.৩০ বিলিয়ন ডলারে।</p> <p>গত বছরের আগস্টে এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এক বছর আগে ২৭ অক্টোবর রিজার্ভ ছিল ৪৬.৫০ বিলিয়ন ডলার।</p> <p>সংকট মোকবেলায় সরকার আইএমএফের কাছে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ চেয়েছে, তা নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল এখন ঢাকায়। এরই মধ্যে গভর্নরসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। তাঁরা রিজার্ভের হিসাব নির্ণয়ে মোট রিজার্ভ ও প্রকৃত রিজার্ভ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার পরামর্শ দিয়েছেন।</p> <p><strong>অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা যা বলছেন</strong></p> <p>সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অর্থনীতির সূচকগুলো চাপের মধ্যে আছে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ে নেতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। সেটা রিজার্ভের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করবে। আমদানিকারকদের ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতেরও এলসি অবসায়ন করার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে আরো সতর্ক হতে হবে।</p> <p>মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমার ধারণা হুন্ডি-হাওলাতে রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে। আবার আন্ডার ইনভয়েসিং করে বাড়তি টাকা হুন্ডির মাধ্যমেও পরিশোধ করা হচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচারের ঘটনা ঘটছে। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন চাপের পাশাপাশি এগুলো আমাদের চলমান সমস্যাকে আরো ঘনীভূত করেছে।’</p> <p>পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর মনে করেন, চলমান সংকট সহজে যাবে না। তাই আইএমএফের ঋণ সফলভাবে পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই ঋণ সংকটে কাজে লাগবে। তিনি বলেন, আমদানি কমেছে, আরো কমাতে হবে। বৈদেশিক সহায়তা বাড়িয়ে রিজার্ভ ঠিক রাখতে হবে। রপ্তানিতে নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে। আন্ত ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময়হারের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে। তাতে পরিস্থিতির ওপর কিছুটা নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যেতে পারে।</p>