<p>কৃষি বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আবহমানকাল থেকেই আমাদের এই জনপদ ছিল কৃষিভিত্তিক, অর্থাৎ মূলত কৃষির ওপর নির্ভর করেই চলত এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারের সূচনা হয়েছে তো মাত্রই গত শতাব্দীতে। কিন্তু তারও হাজার বছর আগে থেকে এই অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন প্রাকৃতিক উপাদান ও সম্পদ এবং স্থানীয় সহজাত জ্ঞানের ব্যবহার করে কৃষিকাজ করত।</p> <p><img alt="দেশের কৃষির হারানো ঐতিহ্য ও বর্তমান সংকট" height="360" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/14-01-2025/Rif/p10-4-14-01-2024.jpg" style="float:left" width="600" />সাম্প্রতিক কয়েক দশকে বাংলাদেশে কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে, একই সঙ্গে বেড়েছে উৎপাদনও, বিশেষ করে ধান, যা আমাদের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ধান উৎপাদক। বাংলাদেশে যে পরিমাণ ধান উৎপন্ন হয় তা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্য চাহিদা মেটে। অথচ সেই কৃষিই এখন নানা সংকটে জর্জরিত। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির অপ্রতুল ব্যবহার এবং রাসায়নিকের ওপর অতিনির্ভরশীলতা বাংলাদেশের কৃষিকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।</p> <p> </p> <p><strong>কৃষির ঐতিহ্য</strong></p> <p>একসময় বাংলাদেশের কৃষি ছিল আত্মনির্ভরশীল। এমনকি ২০০০ সালের আগেও কৃষি খাত দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ১৯৯০-এর দশকে প্রতিবছর ২০ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদন করা হতো। পাশাপাশি গম, পাট, আখ, শাকসবজি এবং নানা ফলের উৎপাদনে এই দেশ ছিল সমৃদ্ধ। মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই তাদের জমি চাষ করত। রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার তখন প্রায় ছিল না বললেই চলে। মাটি ছিল উর্বর, পানি ছিল বিশুদ্ধ। গ্রামীণ অর্থনীতি নির্ভর করত কৃষির ওপর। কিন্তু উন্নয়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে আমাদের ঐতিহ্যবাহী কৃষি পদ্ধতি ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে।</p> <p> </p> <p><strong>বর্তমান চিত্র</strong></p> <p><img alt="দেশের কৃষির হারানো ঐতিহ্য ও বর্তমান সংকট" height="751" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/14-01-2025/Rif/p10-5-14-01-2024.jpg" style="float:left" width="350" />বর্তমানে বাংলাদেশের কৃষি প্রযুক্তি ও রাসায়নিকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়েছে মারাত্মক। মাটির উর্বরতা দিন দিন কমছে, জলাশয় দূষিত হচ্ছে এবং মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। বর্তমানে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শ্রমশক্তি কৃষিতে নিয়োজিত, যা আগের দশকগুলোর তুলনায় অনেক কম, তবে এখনো এটি বাংলাদেশের একটি প্রধান কর্মসংস্থান খাত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততার কারণে জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের কৃষির অবদান মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বর্তমানে কৃষি খাতের অবদান মাত্র ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ।</p> <p> </p> <p><strong>আকস্মিক বন্যা ও ফসলের ক্ষতি</strong></p> <p>২০২০ সালে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যায় প্রায় ১৩ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ২৮২ মিলিয়ন ডলার। গবাদি পশু এবং মাছের খামারগুলোতেও প্রায় ১৫৬ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো খাদ্যসংকটে পড়ে এবং অনেকেই মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়।</p> <p> </p> <p><strong>জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব</strong></p> <p>জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের কৃষি আজ সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে। প্রতিকূল আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে কৃষিজমি নষ্ট হচ্ছে। কুয়াকাটার ভূমিক্ষয়ের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হেক্টর জমি সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আর জমি হারিয়ে কৃষকরা তাঁদের জীবিকা হারাচ্ছেন। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে লবণাক্ত পানিতে অনেক কৃষিজমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ে। ক্ষতি হয় প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলারের।</p> <p> </p> <p><strong>রাসায়নিকের ব্যবহার এবং পরিবেশের ক্ষতি</strong></p> <p>উৎপাদন বাড়াতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার পরিবেশের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত রাসায়নিকের ব্যবহারে মাটির গঠন নষ্ট হয়ে উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি রাসায়নিক সার জমি থেকে পানিতে মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।</p> <p> </p> <p><strong>প্রযুক্তির ব্যবহার : সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা</strong></p> <p>বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটলেও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে কৃষকরা আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উন্নত বীজের সঠিক ব্যবহার করতে পারছেন না। বাংলাদেশে এখনো ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ভূমি কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়, যদিও ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে কৃষিজমির পরিমাণ দিন দিন কমছে। সেচের আওতায় আসা জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত ধান চাষের ক্ষেত্রে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ ধান চাষে সেচের প্রয়োজেন হয়, যার বেশির ভাগেই ব্যবহৃত হয় গভীর ও অগভীর নলকূপ। আধুনিক কৃষি-প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল জাত ও উন্নত সেচব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রতি হেক্টরে ধানের ফলন দাঁড়িয়েছে চার-পাঁচ টন, যা ১৯৯০-এর দশকের তুলনায় অনেকখানি বেশি।</p> <p>বাংলাদেশের কৃষির ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার এবং এর সংকট মোকাবেলায় প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর উদ্যোগ। আমাদের মনে রাখতে হবে, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। প্রখ্যাত কৃষি বিশেষজ্ঞ ড. কে এ এস মুরশিদের কথায়, ‘কৃষি শুধু খাদ্য নয়, এটি আমাদের জীবনের উৎস। তাই কৃষকের উন্নয়ন নিশ্চিত করলেই আমরা জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে পারব।’</p> <p>তাই সময় এসেছে কৃষির প্রতি আরো মনোযোগ দেওয়ার, যাতে এই দেশ তার হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে পারে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।</p>