<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">“‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অনেক স্থানেই বাক্যের প্রণালী অত্যন্ত ইংরেজি।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> লিখছেন কবি, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মনে মনে ভাবছিলেম এখানকার যুবকযুবতীরা সত্যিই কি এমনতরো তর্জমা-করা ভাষাতেই কথাবার্তা কয়ে থাকে? অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় তো আমি এতটা লক্ষ্য করিনি। কথাবার্তায় এরকম কৃত্রিম ঢংটাতে রসভঙ্গ হয় কেননা সমস্ত জিনিসটার সত্যতাকে দাগী করে দেয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> এসব কথা বলেছিলেন তিনি </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সেদিন ফুটল কমল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> পড়ে, আর এর তিন বছর পর ওই একই লেখকের </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাসরঘর</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">-এর প্রশস্তি করে নিন্দাভাজন হন তিনি দিলীপকুমার রায়ের কাছে। দিলীপকুমার অনুযোগ করছেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এর ভাষা </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">Exotic </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মনে হয় না কি বহু স্থলেই?</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> বিস্তর উদাহরণ সাজিয়ে সেদিন দিলীপকুমারই বোঝাচ্ছেন কবিকে, বুদ্ধদেবের গদ্য ইংরেজি ছাঁদে ঢালাই করা, আর সেই কারণে মারাত্মক বাংলা।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’”</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">(নির্মাণ আর সৃষ্টি, শঙ্খ ঘোষ, প্যাপিরাস, সেপ্টেম্বর ২০০৯, পৃষ্ঠা-১০৮)</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কবি, মানে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর সঙ্গেই কথা হচ্ছিল দিলীপকুমার রায়ের। প্রথমে রবীন্দ্রনাথ, পরে দিলীপকুমারও এই অভিযোগে শামিল হয়ে ভাষার স্বাভাবিক ছন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, তা যে রবীন্দ্রনাথেও কীর্ণ হয়ে আছে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সেটা দুজনের কেউ তখন লক্ষ করেননি। শঙ্খ ঘোষ রবীন্দ্রনাথ থেকেই ও রকম ইংরেজি ছাঁদের বাক্যের একাধিক উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন, যদিও সেগুলো লেখকের বিভিন্ন চরিত্রের নিঃসৃত সংলাপ। কিন্তু সংলাপ হলেও তা তো রবীন্দ্রনাথেরই তৈরি। তাহলে বুদ্ধদেব বসুকেই কেন অভিযুক্ত করা হচ্ছে?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলা গদ্যের আদি রূপের কথাই যদি ওঠে, এমনকি বর্ণনার পরিবর্তে শুধুই সংলাপ বা কথোপকথনের ভাষা, সেও কি চিরকাল আদি রূপেই আবদ্ধ থেকেছে? বিবর্তন কি হয়নি মোটেই? ভাষা ও জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বিবর্তন এক ঐতিহাসিক সত্য। পার্শ্ববর্তী ও দূরাগত উপাদান ভাষাকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি মানুষের বাচনভঙ্গি ও সংলাপকেও প্রভাবিত করে থাকে। তা যে করে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অলক্ষ্যে হলেও</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তার প্রমাণ ভাষার দেহে-মনে পুঞ্জীভূত রূপটি আমরা লক্ষ করলেই বুঝতে পারব। বাংলা ভাষার বিবর্তনে ইংরেজি ভাষার বাক্যরীতি ও যতিচিহ্নের প্রভাব একটা বড় ঘটনা।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলা ভাষার আদি গদ্যের যে নমুনা আমরা পাই, বিশেষত চিঠিপত্র ও জমির দলিল সংক্রান্ত, সেগুলো যতিচিহ্নের অভাববশত কখনো কখনো দুরধিগম্য, এমনকি অর্থ করাও মুশকিল। আর সাহিত্যিক নমুনা হিসেবে আমরা গদ্য-পদ্য যেসব দেখতে পাচ্ছি, তাতে এক দাঁড়ি ও দুই দাঁড়ির বেশি কিছু নেই। অর্থাৎ দুই ধরনের যতিচিহ্ন ছাড়া বাংলা ভাষার সঞ্চয়ে আর কিছুই ছিল না। বাঙালিরা ইংরেজি ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার সংস্পর্শে এসে বহু ধরনের যতিচিহ্নের সঙ্গে শুধু পরিচিতই হলেন না, বাংলা ভাষায় তার প্রয়োগ করতে শুরু করলেন। বাঙালি লেখক ও ভাবুকদের মধ্যে সম্ভবত রামমোহন রায় তাঁর গদ্যে দাঁড়ি, কমা, ঊর্ধ্ব কমা, ড্যাশের ব্যাবহার শুরু করলেন, যা নিশ্চিতভাবেই ইংরেজি ভাষার সংস্পর্শে আসারই ফল। তবে সুকুমার সেনের </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> শীর্ষক গ্রন্থে দেখতে পাচ্ছি, ফ্রান্সিসকো ফের্নাদেজ নামের এক পর্তুগিজ পাদ্রির ১৫৯৯ সালে বাংলায় লেখা চিঠির একটি নমুনা, যেখানে দাঁড়ি, কমা ও ড্যাশের ব্যাবহার লক্ষ করা যাচ্ছে। এ যদি সত্য হয় তাহলে বলতেই হবে, বাংলা বাক্যরীতির ওপর বিদেশি প্রভাব ইংরেজ আমলে নয়, বরং তারও আগে থেকে। এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সে নিয়ে আমার একটু সংশয় দেখা দিচ্ছে এই কারণে যে সুকুমার সেন এই উদ্ধৃতির টীকায় উৎস সম্পর্কে লিখেছেন, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">“</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বার্থলোমে আলকাজারের </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ক্রোনো হিসটোরিআ দে লা কামপাঞিআ দে য়েসুস</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> দ্বিতীয় খণ্ড (মাদ্রিদ, ১৭১০) হইতে বার্নেট কর্তৃক ইংরেজীতে অনূদিত এবং গ্রীয়ার্সন কর্তৃক </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লিঙ্গুইসটিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> প্রথম খণ্ড প্রথম ভাগে উদ্ধৃত (পৃষ্ঠা-২২৩)।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">”</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস-৩, সুকুমার সেন, আনন্দ, কার্তিক ১৪১৬, পৃষ্ঠা-৩২)। প্রশ্ন হলো, ফ্রান্সিসকো সত্যি সত্যি এই তিন ধরনের যতিচিহ্ন ব্যবহার করেছিলেন কি না। সংশয় এই কারণে যে ফ্রান্সিসকোর ওই লেখাটি বার্নেট কর্তৃক অনূদিত এবং গ্রীয়ার্সনের গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। ফলে অনুবাদ বা উদ্ধৃত করার সময় নিজেদের মতো যতিচিহ্ন বসিয়ে নিয়েছেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ কম। তবু যদি ধরেও নিই যে ১৫৯৯ সালেই বাংলায় নানা রকম যতিচিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তাহলে সেটা অবাঙালিদের হাতেই ঘটেছে, এবং ইউরোপীয় ভাষার স্বভাব অনুযায়ী সেটা হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। বাঙালি লেখকরা নানা রকম যতিচিহ্নের ব্যবহার শুরু করেছেন অনেক পরে। গদ্যে সম্ভবত রামমোহন রায়ের হাতেই লক্ষ করার মতো সূচনা আমরা দেখতে পাব। তারপর বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথে এর এক পরিপূর্ণ রূপ আমরা দেখতে পাই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রশ্ন হলো, যতিচিহ্ন ভাষার ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? ভাষায় বাক্যসংগঠন নিশ্চিতভাবেই ভাবনার কাঠামোকে অনুসরণ করেই গড়ে ওঠে। ভাবনার সারাৎসার ও তার গড়ন অনুযায়ী বাক্যরীতি ও কাঠামো যদি রূপ লাভ করে তাহলে যতিচিহ্ন সেই ভাবনাকে সুশৃঙ্খল বিন্যাসের দায়িত্ব পালন করে। শুধু সুশৃঙ্খল বিন্যাসই নয়, তা অভিব্যক্তির সক্ষমতাকেও তীক্ষ ও প্রসারিত করে। চিন্তার জটিল রূপটিকেও দীর্ঘ বাক্যে যতটা সক্ষমভাবে রূপ দেওয়া যায়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">যতিচিহ্নের যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তা বাংলা ভাষার আদি দুই যতিচিহ্নের মাধ্যমে কখনোই সম্ভব হতো না। ফলে যে যতিচিহ্নসহ ইংরেজি বা ইউরোপীয় অন্যান্য ভাষার বাক্যরীতি আমরা পেয়েছি, তা আমাদের ভাষিক সক্ষমতাকে একদিকে যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি তাতে এনেছে বৈচিত্র্য। রবীন্দ্রনাথের কাছে তা যে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তর্জমা-করা ভাষা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">র মতো মনে হবে তা খুবই স্বাভাবিক, কারণ এ তো বহিরাগত। যেকোনো ভাষার ও সাহিত্যের বিকাশের জন্য অন্য ভাষা ও সাহিত্য সব সময়ই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ভাষা ও সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাস আমাদের সেই সাক্ষ্যই দেয়। রবীন্দ্রনাথের পর তিরিশের কবিরা পশ্চিমী সাহিত্যকে ইংরেজি অনুবাদে অনুধাবন করতে গিয়ে নিজেদের সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি তাঁদের গদ্যরচনায়ও পড়েছে ইংরেজি বাক্যরীতির স্পষ্ট প্রভাব। রবীন্দ্রনাথের পর তিরিশের লেখকদের হাতে বাংলা গদ্যের যত বিস্তার ঘটেছে তা তো ওই বহুবিধ যতিচিহ্নসম্পন্ন বাক্যরীতির কারণেই, আর তা এসেছে ইংরেজি ভাষার স্বভাব থেকেই। দেশীয় শ্রুতিতে তা কৃত্রিম শোনালেও নতুন রসও কি তাতে সঞ্চার করেনি?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রবন্ধ হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধদেব বসুর গদ্য যে এত কুহকীশক্তি নিয়ে আমাদের আবিষ্ট করে রেখেছে, তা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ইংরেজি ছাঁদে ঢালাই</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কৃত যতির বৈচিত্র্য ও জটিল বাক্য সত্ত্বেও</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আজ আর আমাদের কাছে দূরাগত ও </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">তর্জমা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> বলে মনে হয় না। দুটি নজির আমরা বুদ্ধদেব বসু থেকেই এক্ষুনি পড়ে দেখতে পারি :</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১. </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">মনে-মনে তার ধারণা যে পৃথিবীটাকে বদলে দেবার জন্যই সে এসেছে, কিন্তু তার ইচ্ছেমতো পৃথিবীর এক চুল বদল হবে না, সব দিকেই বয়স্কদের পাষাণ-রাজত্ব অটুট থেকে যাচ্ছে; এমনকি বাস্তব জীবনে সে নিজেও তার আদর্শকে সব সময় অক্ষুণ্ন রাখতে পারছে না, প্রায়ই ঘটছে স্খলন-পতন, এবং এ-নিয়ে তার মনে একটি তীব্র বিক্ষোভের তোলপাড় অবিশ্রান্ত চলেছে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> (বুদ্ধদেব বসুর প্রবন্ধসমগ্র-১, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, জানুয়ারি ২০১৫, পৃষ্ঠা-২৬৭)</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই বাক্য ইংরেজি ছাঁদে গড়ে উঠেছে ঠিকই, কিন্তু বলার ধরনে রয়েছে এমন এক প্রসাদগুণ, যা পাঠককে বিমুখ করে না কোনোভাবেই।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">২. </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">“‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আর এমনি  ক</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রে অজানায় পৌঁছানো!</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবার বোদলেয়ারীয় জগতে প্রবেশ করছি আমরা, পান করছি </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ফ্ল্যর দ্যু মাল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">-এর সারাৎসার; আমাদের মনে প</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ড়ে যাচ্ছে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রতিসাম্য</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভ্রমণ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> ও </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সিথেরায় যাত্রা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">, মদ ও মৃত্যুর কবিতাগুচ্ছ; প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গদ্যকবিতা ও </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্তরঙ্গ ডায়েরি</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">র সেই সব অংশ (আর কোন অংশই বা তেমন নয়), যেখানে কবি সাহস করেছিলেন আপন আত্মার অনাবরণ উন্মোচনে।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">”</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> (অনুবাদ কাব্যসমগ্র, বুদ্ধদেব বসু, অবসর, ফেব্রুয়ারি ২০১৩, পৃষ্ঠা-১৮১)</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দ্বিতীয় উদাহরণের বাক্যটি আরো বেশি জটিল; ইংরেজি ভাষার যতিচিহ্নের বেশির ভাগই এতে ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু পাঠকের শ্রুতিকে তা পীড়িত করে না, কিংবা অচেনা বলে আমাদের পাঠাভ্যাসকে ব্যাহত করে না। সত্য বটে বাংলা গদ্যের সেই প্রাচীন রীতির এ ঘোরতর বিরোধী। কিন্তু অভিব্যক্তির দিক থেকে এই বাক্য আমাদের কাছে অনেক বেশি কুসুমিত ও শ্রুতিমধুর। বাংলা প্রবন্ধে ইংরেজি ছাঁদে সম্ভবত দীর্ঘতম বাক্যটির রচয়িতা জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় যেমন, তেমনি গদ্যেও রয়েছে ইংরেজির অনুসরণে জটিল ও যতিচিহ্নবহুল দীর্ঘ বাক্য।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">“</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কোন যুগ কাব্যের কি জিনিসের উপর জোর দিচ্ছে, কবিতার কয়েকটা দিককেই সমস্ত দিক মনে করে তখনকার সমাজের কোন ধরনের প্রয়োজনে কি সুবিধা পাচ্ছে, কবিতার নিত্যের বা অক্ষরতার দিক থেকে কতখানি নিরর্থক হয়ে পড়ছে, সে জিনিসকে সম্পূর্ণভাবে ফলিত করবার শক্তি কাব্যের কোনো একান্ত, আসল যুগেও নেই, কেননা তা থাকতে পারে না; কিন্তু সে জিনিসের কম বা বেশি প্রকাশ নিয়ে কাব্যের প্রতিটি ছোট মাঝারি বড় যুগের ইতরবিশেষ; রবীন্দ্রকাব্যে ঐ পদার্থ কম ছিল বা ঈসকাইলাস সোফোক্লিসের গ্রিক কাব্যে, অথবা দান্তের ভিতর; আরো প্রাণপ্রসারিত হয়েছিল শেকসপীয়র ও এলিজাবেথানদের কাব্যে; তারপর চারশতকের কাব্য, আধুনিক কবিতা; ব্লেকের মতন একজন কবির কবিতা, রসাত্মক বাক্য বা সমাজচেতন আবেগ বললে যাঁর কাব্যের কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞাই দেওয়া হয় না; অথবা প্রতীকযানের কিংবা চেতনা-অনুচেতনার কবিতা সব; অন্য দিক দিয়ে  রিলকের কাব্য</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ব্লেকের কবিতার চেয়ে এত ভিন্ন, অথচ ব্লেকের মতনই একটা নতুন সম্ভাবনা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হয়তো সিদ্ধির উন্মেষ এইখানে, বাংলাদেশে ব্লেক বা রিলকের মতো কোনো কবি নেই, কিন্তু প্রতীকযানের ভালো কবিতা রয়েছে আধুনিক কালে; আগেকার যুগে অল্প পরিসরের ভিতর আশ্চর্য সিদ্ধি রয়েছে বৈষ্ণব কবিতায়, এর স্বদেশ সব সময়ের জন্য বাংলাতেই এরকম কোনো ধরতাই সিদ্ধান্তের (সিদ্ধান্তটি মোটামুটি অখণ্ডনীয় মনে হচ্ছে আমার) উল্লেখ না করেও বলতে পারা যায় অন্য দেশে ভিলোঁকে দেখেছি, ডান, ম্যাটাফিজিক্যাল কবিগোষ্ঠি, হাইনে, হোয়েল্ডেরলিনকে; (অর্থ ও পদ্ধতির দিক দিয়ে বৈষ্ণব কাব্যের সঙ্গে এসব বা অন্য কোনো কবিতার তুলনা তেমন কিছু প্রাসঙ্গিক নয়</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কিন্তু বিভিন্নতা সত্ত্বেও কবিতার উৎকর্ষের একটা বিশেষ স্তরের কথা মনে রেখে বৈষ্ণব পদাবলীর সম্পর্কে ধারণা আরো স্থির করতে গিয়ে এইসব কবিতার উল্লেখ করা গেল), কবিতার একটা দীন, অনবলীন </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">গভীর</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বৈষ্ণব পদাবলী  ছাড়া অন্য কোথাও সম্ভব নয়; একেবারেই বিভিন্ন আর এক রকম রচনা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কোনো কোনো দেশে যাকে বলা হয় মার্কসীয় পদ্ধতিতে নির্ভুল, প্রামাণ্য কবিতা (আমি ঠিক জানি না জিনিসটি কী, কোনো সুস্পষ্ট উদাহরণ দেখিনি); আরো নানা রকম কবিতা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">খুবই জ্ঞাত ও বিখ্যাত বলে উল্লেখ করা গেল না</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই সমস্ত কাব্য মিলিয়ে কবিতার চিরপদার্থের একটা মোটামুটি স্বরূপ সম্মন্ধে আমাদের জ্ঞান হয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">”</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> (কবিতার কথা, সিগনেট প্রেস, চতুর্থ সংস্করণ : মাঘ ১৩৮৭, পৃষ্ঠা-৭৯-৮০)</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">একটিই মাত্র বাক্য, এর শরীরে ইংরেজি যতিচিহ্নের প্রায় সবগুলোই ব্যবহৃত হয়েছে। অতিদীর্ঘ হওয়ায় স্বভাবতই এটি জটিল হয়েছে, ফলে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনুধাবন ক্ষণে ক্ষণেই বাধাগ্রস্ত হয় এবং নিশ্চিতভাবেই খানিকটা কৃত্রিমও শোনায়। জীবনানন্দের প্রবন্ধের গদ্য সুধীন দত্তের মতোই কৃত্রিম ঢঙের। এবং এতে খানিকটা রসভঙ্গও হয়। কিন্তু উদ্ধৃত এই বাক্যটি ভাষার জন্য এক পরীক্ষাও বটে। এই বাক্য জটিল, কারণ এতে বাকাংশগুলো পরস্পরের সঙ্গে যতিচিহ্নের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে আছে। আর বাক্যাংশগুলো একে অপর থেকে বিষয়ে আলাদা; অসংখ্য বিষয়কে তিনি একটি বাক্যের মধ্যে ঠেসে দিয়েছেন। কেবল বাংলা প্রবন্ধেই নয়, ইংরেজি প্রবন্ধের ইতিহাসেও এমনটা খুব বেশি দেখা যাবে না। তবে যতই ইংরেজি ছাঁদে গড়ে উঠুক না কেন, এমনকি তা জটিল হলেও, অবোধ্য থাকেনি শেষ পর্যন্ত। ভাষার অভিব্যক্তির বৈচিত্রের স্বার্থে এই ধরনের বিদেশি বাক্যরীতির প্রয়োগ সুফলদায়ী বলেই আমার ধারণা। তবে প্রয়োগটাকে যদি বুদ্ধদেব বসুর গদ্যের মতোই রসাত্মক ও স্বচ্ছ করে তোলা যায় তাহলে এর অভিঘাত পাঠকমনে আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রবীন্দ্রনাথ ও দিলীপকুমার সম্ভবত লক্ষ করেননি যে যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে অলক্ষ্যে ভাষাভঙ্গিও ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। আর এই পাল্টে যাওয়াও ছিল অনিবার্য, কারণ যাঁদের হাতে এই ভাষা নির্মিত হয়েছে, তাঁরা এমন একটি ভাষায় পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেদের রুচি ও অভ্যাস গড়ে তুলেছেন যে তার প্রভাব মাতৃভাষায় এড়ানো সম্ভবত ছিল না। তা ছাড়া যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তনও অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। ভাষার গড়ন ও চলনেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। নানা পরিবর্তনের প্রপঞ্চসমূহ আমাদের মনর্গঠনেও ভূমিকা পালন করে। এই পরিবর্তনসমূহ লেখকের মনোরসায়নের বিক্রিয়ার ফলে ভাষায় তার প্রকাশ যখন ঘটবে তখন প্রচলিত ভাষারীতি ও বাক্যরীতিকে লঙ্ঘন করেই তা ঘটবে।</span></span></span></span></p>