<p>মেধা বা বুদ্ধিমত্তা মানুষের মধ্যে একধরনের সমীহ জাগানিয়া মনোভাব আছে। কারো মেধা বেশি হলে তাকে বলা হয় ‘জিনিয়াস’, আর কারো কম হলে তাকে সাদামাটা মনে করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো- মেধা কি জন্মগত, নাকি এটি পরিশ্রম ও পরিবেশের মাধ্যমে অর্জিত হয়? বিজ্ঞান এই প্রশ্ন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছে। কী বলছে সেসব গবেষণা?</p> <p>মেধা এবং বুদ্ধিমত্তা কী?</p> <p>মেধা বলতে সাধারণত বুদ্ধি, স্মৃতিশক্তি এবং সমস্যার সমাধান করার দক্ষতাকে বোঝায়। বিজ্ঞানীরা মেধা পরিমাপ করতে আইকিউ (ইন্টেলিজেন্স কোটিয়েন্ট) স্কোর ব্যবহার করেন। অবশ্য মেধার সঠিক সংজ্ঞা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন হতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা একমত যে এটি জেনেটিক এবং পরিবেশগত উভয় প্রভাবের সমন্বয়ে মেধার মান নির্ধারিত হয়।</p> <p>বিজ্ঞান কী বলে?</p> <p>বিজ্ঞানের ভাষায় মেধা দুরকম—জিনগত বা সহজাত মেধা ও পরিবেশগত বা অর্জিত মেধা। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের গবেষক ড. রবার্ট প্লোমিন। তিনি জেনেটিক এবং বুদ্ধিমত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। তার মন্তব্য হলো, ‘গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মেধার একটি বড় অংশ অর্থাৎ ৫০-৭০% জেনেটিকভাবে নির্ধারিত। তবে পরিবেশের প্রভাব, বিশেষ করে শৈশবকালের অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা, মেধার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’</p> <p>ড. প্লোমিনের গবেষণা টুইন স্টাডির ওপর ভিত্তি করে, যা দেখায় যে যমজ শিশুর বুদ্ধিমত্তার মধ্যে অত্যন্ত মিল থাকে, এমনকি তারা আলাদা পরিবেশে বেড়ে উঠলেও।</p> <p>২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস একটি গবেষণা চালায়। তাতে দেখা যায়, বুদ্ধিমত্তার বেশির ভাগ অংশই ডিএনএতে প্রগ্রাম করা থাকে।</p> <p>জিনের পাশাপাশি পরিবেশও মেধার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার সুযোগ, পারিবারিক পরিবেশ এবং খাদ্যাভ্যাস মেধাকে উন্নত করতে সাহায্য করে</p> <p>জিনের পাশাপাশি পরিবেশও মেধার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষার সুযোগ, পারিবারিক পরিবেশ, এবং খাদ্যাভ্যাস মেধাকে উন্নত করতে সাহায্য করে। যেমন, দরিদ্র পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুর বুদ্ধিমত্তা পর্যাপ্ত পুষ্টি, শিক্ষা, এবং মানসিক সহায়তার অভাবে সীমিত হতে পারে।</p> <p>১৯৭৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, পঠনপাঠনের  সুবিধা আছে এমন এমন পরিবারে বেড়ে ওঠা শিশুদের আইকিউ স্কোর তুলনামূলকভাবে বেশি।</p> <p>বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মেধার ক্ষেত্রে সহজাত এবং অর্জিত উভয় প্রভাবই গুরুত্বপূর্ণ। সহজাত মেধা হলো একটি ভিত্তি, যা মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে। তবে এই মেধাকে আরো শাণিত করা যায় সঠিক শিক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং প্রেরণার মাধ্যমে।</p> <p>একজন সহজাত মেধাবী ব্যক্তি যদি অধ্যবসায় এবং সঠিক দিকনির্দেশনা না পান, তবে তার মেধা হয়তো সঠিকভাবে বিকশিত হবে না।</p> <p>অন্যদিকে, একজন সাধারণ মেধার ব্যক্তি যদি কঠোর পরিশ্রম এবং সঠিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন, তবে তিনি অসাধারণ সাফল্য অর্জন করতে পারেন।</p> <p>স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষক ও মাইন্ডসেট থিওরি ড. ক্যারোল ডুইক বলেন, ‘মেধা শুধু জন্মগত নয়, এটি পরিবর্তনশীল। একজন ব্যক্তির 'গ্রোথ মাইন্ডসেট' (শেখার ইচ্ছা এবং চেষ্টার মানসিকতা) বুদ্ধিমত্তাকে বাড়াতে সহায়ক।’</p> <p>ড. ডুইক মনে করেন, শিশুদের শেখার পরিবেশ এবং তাদের প্রতি পজিটিভ প্রতিক্রিয়া তাদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাঁর গবেষণা দেখিয়েছে, যারা মনে করে মেধা চর্চার মাধ্যমে বাড়ানো যায়, তারা সাধারণত সাফল্যের পথে অনেক এগিয়ে থাকে।</p> <p>মেধার উন্নয়ন সম্ভব?</p> <p>বিজ্ঞান বলছে, মেধা একটি স্থির বৈশিষ্ট্য নয়। এটি চর্চার মাধ্যমে উন্নত করা সম্ভব। কিছু কার্যকর পদ্ধতি যেমন- শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে অর্থাৎ নিয়মিত নতুন বিষয় শেখার চেষ্টা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ায়। মস্তিষ্কের ব্যায়াম যেমন- দাবা খেলা, ধাঁধা সমাধান এবং সৃজনশীল কাজ বুদ্ধিমত্তা উন্নত করে।</p> <p>যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি গবেষক ড. হাওয়ার্ড গার্ডনার তাঁর মাল্টিপল ইন্টেলিজেন্স থিওরি তত্ত্বে বলেন, মেধা একমাত্র IQ বা জেনেটিক ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করে না। এটি একটি বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের বিভিন্ন ধরনের মেধা থাকতে পারে, যেমন ভাষাগত, সংগীত, শারীরিক, বা আন্তঃব্যক্তিক ‘</p> <p>গার্ডনারের মতে, মেধার বিকাশে পরিবেশ, শিক্ষাগত সুযোগ, এবং সামাজিক প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রতিটি ব্যক্তির মেধা ভিন্ন, এবং এটি বিকশিত হতে সঠিক পরিবেশ এবং চর্চার প্রয়োজন।</p> <p>স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন- ফলমূল, বাদাম এবং সবুজ শাকসবজি মস্তিষ্ককে কার্যকর রাখে। ফলে খাদ্যাভ্যাসও মেধার ওপর প্রভাব রাখতে পারে। মেডিটেশন এবং মানসিক চাপ কমানোর পদ্ধতি বুদ্ধির বিকাশে সাহায্য করে।</p> <p>মোদ্দাকথা হলো, মেধা আংশিকভাবে সহজাত হলেও এটি চর্চা এবং সঠিক পরিবেশের মাধ্যমে বিকশিত করা সম্ভব। বিজ্ঞান বলছে, জিন আমাদের সম্ভাবনা নির্ধারণ করে, কিন্তু পরিবেশ এবং পরিশ্রম সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবতায় রূপ দেয়। তাই মেধাকে উন্নত করার জন্য সঠিক শিক্ষা, প্রচেষ্টা এবং মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন সহজাত মেধাবী বা সাধারণ মেধার ব্যক্তিই হোন না কেন, সাফল্যের চাবিকাঠি হলো অধ্যবসায় এবং চর্চা।</p> <p>সূত্র : ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস ও আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন<br />  </p>