<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">২০০৯ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনে দেশে যে আর্থিক দুর্দশা দেখা দিয়েছে, তা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরি করতে নিয়োজিত প্যানেলকে তিন মাস কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২৮ আগস্ট প্রজ্ঞাপনে শেখ হাসিনার শাসনে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের অব্যবস্থাপনার গভীরতা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা জানানো হয়। ১২ সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলের তৈরি শ্বেতপত্রটি গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পেশ করা হয়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্বেতপত্রে অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। এতে নব্য ধনীদের উত্থান, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মিথ্যা বিবরণ দিতে ভুল তথ্য পরিবেশন ও ব্যাপক হারে অর্থপাচারের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এটি করতে ২২টি নীতিভিত্তিক পরামর্শ, ১৭টি কারিগরি পরামর্শ বৈঠক, তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার এবং ঢাকার বাইরে তিনটি গণশুনানি করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য দিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি হয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে ১৫ বছরে চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনৈতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ছিলেন আমলারা, সামরিক ও বেসামরিক উভয়ই। চোরতন্ত্রের কারণে তিনটি নির্বাচনই বিতর্কিত হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহির ঘাটতি ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এমনটাই বলা হচ্ছে শ্বেতপত্রে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্বেতপত্রে গত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনে সীমাহীন দুর্নীতি, পাচার কিংবা লুটপাটের দৃষ্টি আকর্ষক তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের ধারণা, যেসব খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে থাকবে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্য-প্রযুক্তি। ১৫ বছরে দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="অর্থনীতির শ্বেতপত্র ও আগামী দিনের সতর্কবার্তা" height="151" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/31-12-2024/66.jpg" style="float:left" width="321" />শ্বেতপত্রে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ তছরুপ ও অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগাপ্রকল্পগুলোতে। ১৫ বছরে প্রকল্পের খরচ গড়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১ থেকে ২.৮ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আরো বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রো রেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। ধারাবাহিক ঋণ খেলাপের ঘটনা এবং বড় ধরনের কেলেঙ্কারিগুলো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতকে ধ্বংস করেছে এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে বলেও শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ ছাড়া অভিবাসন খাতে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা সরানো হয়েছে হুন্ডিতে লেনদেনের মাধ্যমে। মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর  ভিসা ক্রয়ের মাধ্যমে টাকা বিদেশে গেছে। তারাই বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রচুর অর্থ আত্মসাৎ করেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়, পাচারকৃত এই টাকা মতিঝিল-উত্তরা রুটের মেট্রো রেল নির্মাণ খরচের চার গুণ। সিন্ডিকেট ও অনৈতিক রিক্রুটমেন্ট চর্চার কারণে সত্যিকার অভিবাসী কর্মীরা ক্ষতির শিকার হয়েছেন এবং রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">শ্বেতপত্রে আরো বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভুয়া বরাদ্দগুলোর কারণে লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। সামাজিক সুরক্ষা প্রগ্রামের মধ্যে তহবিলের অযথা ব্যয় লাখ লাখ মানুষকে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ২০২২ সালে ৭৩ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাভোগী গরিব হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়নি।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জলবায়ু তহবিলে দুর্নীতির কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে বাজেট ব্যয় না করে তা অন্য খাতে ব্যয় করার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে শ্বেতপত্রে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখা গেছে, প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি প্রকল্পের মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা সাত লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে এক লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ব্যয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইচ্ছাকৃতভাবে ৭০ শতাংশ বাজেট বাড়ানো হয়েছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে তিন বিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির বিধান করে দুর্নীতির রাজকপাট খুলে দেওয়া হয়েছিল গত সরকারের সময় এবং নীতি করেই দুর্নীতির পথ সুগম দেওয়া হয়েছিল।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে উল্লেখ করেন, দুর্নীতির মাধ্যমে যে অর্থ পাচার হয়েছে, সেটি দেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে থেকে যাবে। অর্থের পাচার ধরা খুবই কঠিন। আদায়ের চেষ্টা করার কথা বলা হয়েছে। শ্বেতপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকিতে আছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ে গেছে। তাদের অভিমত, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সংস্কার ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের উপায় নেই। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে দীর্ঘ মেয়াদে সংস্কার কার্যক্রমও ঝুঁকিতে পড়বে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্য-উপাত্ত প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসার সুযোগ নেই। তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত গ্র্যাজুয়েশনের জন্য সব মানদণ্ড পূরণ করেছে। তাই গ্র্যাজুয়েশন স্থগিত করার কোনো কারণ নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ভবিষ্যতে দেশের শাসনভার যাদের ওপর বর্তাবে, তারাও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় সতর্ক হতে বাধ্য হবে। অর্থনৈতিক অনিয়ম ও লুটপাটে যারা জড়িত, বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর ধ্বংসের জন্য দায়ী, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যেসব অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে তা আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : ব্যাংকার ও কলামিস্ট</span></span></span></span></p>