দ্রুত নির্বাচনসহ কিছু দাবিতে কাল থেকে মাঠে নামছে বিএনপি

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
দ্রুত নির্বাচনসহ কিছু দাবিতে কাল থেকে মাঠে নামছে বিএনপি

দেশের চলমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাসহ বিভিন্ন জনদাবিতে মাঠে নামছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে আগামীকাল বুধবার থেকে ৬৭ সাংগঠনিক জেলায় সমাবেশ করবে দলটি। সমাবেশে যোগ দিতে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা তৃণমূলে যাচ্ছেন।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সহনীয় পর্যায় রাখা, অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং পতিত ফ্যাসিবাদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলার দাবিতে আগামীকাল ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে সমাবেশ শুরু হবে।

আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই কর্মসূচি শেষ হবে। জেলা পর্যায়ে সমাবেশের পর পর্যায়ক্রমে মহানগর ও বিভাগীয় সদরে সমাবেশ হবে।

গতকাল সোমবার দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সমাবেশের দিনক্ষণ ও কেন্দ্রীয় নেতারা কে কোন জেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন, সেই তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। 

১২ ফেব্রুয়ারি : লালমনিরহাটে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সিরাজগঞ্জে নজরুল ইসলাম খান, ফেনীতে সালাহউদ্দিন আহমেদ, খুলনায় মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ বীরবিক্রম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, রাজবাড়ীতে ড. আসাদুজ্জামান রিপন, পটুয়াখালীতে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সুনামগঞ্জে আরিফুল হক চৌধুরী এবং জামালপুরের সমাবেশে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল।

১৭ ফেব্রুয়ারি : যশোরে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, টাঙ্গাইলে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, মাদারীপুরে বেগম সেলিমা রহমান, চাঁদপুরে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঠাকুরগাঁওয়ে শামসুজ্জামান দুদু, বগুড়ায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, মৌলভীবাজারে আরিফুল হক চৌধুরী ও ভোলায় জহির উদ্দিন স্বপন।

১৮ ফেব্রুয়ারি : কক্সবাজারে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, পাবনায় ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, পঞ্চগড়ে ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, কুমিল্লা দক্ষিণে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক, ঝিনাইদহে আবুল খায়ের ভূঁইয়া, মানিকগঞ্জে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, হবিগঞ্জে যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি এবং নেত্রকোনায় সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।

১৯ ফেব্রুয়ারি : নোয়াখালীতে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সিলেটে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কিশোরগঞ্জে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ফজলুর রহমান, কুষ্টিয়ায় মিজানুর রহমান মিনু, শরীয়তপুরে ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, পিরোজপুরে মজিবুর রহমান সারোয়ার এবং রাজশাহীতে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী।

২০ ফেব্রুয়ারি : ঢাকায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, লক্ষ্মীপুরে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বরিশাল দক্ষিণে সেলিমা রহমান, ময়মনসিংহ দক্ষিণে ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ফরিদপুরে ভাইস চেয়ারম্যান ড. আসাদুজ্জামান রিপন, চুয়াডাঙ্গায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, নওগাঁয় মিজানুর রহমান মিনু এবং কুড়িগ্রামে আবদুস সালাম।

২২ ফেব্রুয়ারি : ঝালকাঠিতে ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, চট্টগ্রাম দক্ষিণে আহমেদ আজম খান, ময়মনসিংহ উত্তরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জয়পুরহাটে হারুনুর রশীদ, কুমিল্লা উত্তরে মাহবুব উদ্দিন খোকন, বান্দরবানে আসলাম চৌধুরী, রংপুরে আবুল খায়ের ভূঁইয়া এবং নরসিংদীতে যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ।

২৪ ফেব্রুয়ারি : মুন্সীগঞ্জে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বরিশাল উত্তরে মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, নড়াইলে ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী, নাটোরে আহমেদ আজম খান, গাইবান্ধায় চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হারুনুর রশীদ, রাঙামাটিতে যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, মাগুরায় আবদুস সালাম আজাদ এবং সৈয়দপুরে এমরান সালেহ প্রিন্স।

২৫ ফেব্রুয়ারি : নারায়ণগঞ্জে জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গাজীপুরে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, চট্টগ্রাম উত্তরে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বাগেরহাটে ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লা বুলু, সাতক্ষীরায় নিতাই রায় চৌধুরী, দিনাজপুরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, মেহেরপুরে আমান উল্লাহ আমান, নীলফামারীতে জয়নুল আবদিন ফারুক, খাগড়াছড়িতে মনিরুল হক চৌধুরী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে আবদুস সালাম।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

বাবুর ‘ক্যাশিয়ার’ লাক মিয়া

১৫ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক

আসাদুজ্জামান নূর আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ)
আসাদুজ্জামান নূর আড়াইহাজার (নারায়ণগঞ্জ)
শেয়ার
১৫ বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক
লাক মিয়ার বিলাসবহুল বাড়ি। ছবি : সংগৃহীত

রাজনীতিকে আলাদীনের চেরাগ বানিয়েছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান লাক মিয়া। নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের (আড়াইহাজার) সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, সুতার বাজারের সিন্ডিকেট, মানি লন্ডারিং, জোর করে জমি দখল, মাদক কারবারসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যাতে নাম জড়ায়নি লাক মিয়ার। এসবের বদৌলতে মাত্র দেড় যুগে বনে গেছেন ১০ হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এমপি নজরুল ইসলাম বাবু তাঁর অবৈধ পথে উপার্জিত হাজার কোটি টাকা লাক মিয়ার ব্যাবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেশের বাইরে পাচার করেছেন। একসময়ের দিনমজুর বাবার ছেলে লাক মিয়ার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়ায় বিস্মিত আড়াইহাজারের সাধারণ মানুষ। তারা লাক মিয়ার অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত লাক মিয়া ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী।

নজরুল ইসলাম বাবুর প্রভাব খাটিয়ে লাক মিয়া হয়ে ওঠেন আড়াইহাজারের গডফাদার। গঠন করেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। এমপি বাবুর দুর্নীতির টাকা বিনিয়োগে নিরীহ মানুষের জমি দখল করে একের পর এক গড়ে তোলেন শিল্প-কারখানা। মাত্র দেড় যুগে গড়ে তোলেন স্পিনিং মিল, ফিসারিজ, জমির ব্যবসা, মার্কেটসহ কয়েক ডজন প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ লাক মিয়া ও তাঁর পরিবারের লোকজনের নামে।

আড়াইহাজার-ভুলতা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিনাইচর গ্রামে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার শিল্প-কারখানা ভাই ভাই স্পিনিং মিলস লিমিটেড। সড়কের দুই পাশে একে এক গড়ে তোলা হয়েছে জামান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, লতিফা স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও সাবেদ আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ১০টি ইউনিট। কারখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ স্পেন্ডেল। পোশাকশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, স্পিনিং মিলগুলোর বাজারমূল্য প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

দুদকের অনুসন্ধানে মিলেছে লাক মিয়ার এক হাজার বিঘা জমির সন্ধান। যার বেশির ভাগ সরকারি সম্পত্তি বা জোর করে দখল করা অন্যের জমি। ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের মারোয়াদি, লস্করদী, মূলবান্দী, দিঘলদী, উজানগোবিন্দ, বিনাইচর, মনোহরদীসহ ১৪টি মৌজায় ৯১ একর ৫৯ শতাংশ এবং আড়াইহাজার পৌরসভার মধ্যে থাকা কামরাঙ্গীর চর, আড়াইহাজার ও ঝাউঘারা মৌজায় ১৭ একর ৯৬ শতাংশ ২১ অজুতাংশ জমির প্রমাণ ও তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া বাড্ডা, খিলক্ষেতসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় বাড়ি, ফ্ল্যাট ও প্রায় দেড় শ কাঠা জমি রয়েছে তাঁর। পূর্বাচলেও লাক মিয়ার বিপুল পরিমাণ জমি রয়েছে। এ ছাড়া নরসিংদীতে রয়েছে তাঁর জমি। যার বাজার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা।

এসব জমি ছাড়াও লাক মিয়ার বিপুল পরিমাণ মানি লন্ডারিংয়ের তথ্য পেয়েছে দুদক। নামে-বেনামে করা এসব প্রতিষ্ঠানের নামে গত ১৬ বছরে লাক মিয়া অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। আর এসব টাকার কোনো তথ্য আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ পর্যন্ত লাক মিয়ার নামে ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে ৪৯টি। তাঁর স্ত্রীর নামে ১৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ২৩০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা লেনদেনের সন্ধান মিলেছে।

আড়াইহাজার উপজেলার গোবিন্দি গ্রামে লাক মিয়ার পুরনো বাড়ি। ওই বাড়ির পাশেই ১৫ বিঘা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন আলিশান বাড়ি। বাড়িটির নির্মাণকাজ চলছে আট বছর ধরে। ওই বাড়িতে রয়েছে অত্যাধুনিক সুইমিংপুল, ফোয়ারা এবং বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। ভেতরে রয়েছে জলসা ঘরসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। দেশি-বিদেশি উপকরণে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাড়িটিতে বর্তমানে চলছে ফিনিশিংয়ের কাজ।

বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মী হান্নান মিয়া জানান, স্যার তাঁর পছন্দ অনুযায়ী ধীরে ধীরে বাড়ির কাজ করছেন। আশা করছি, আর কয়েক মাসের মধ্যে বাড়ির সব কাজ সম্পন্ন হবে।

স্থানীয় টেক্সটাইল কারখানার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ীরা জানান, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জসহ  দেশের সুতার বাজারের সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন লাক মিয়া। তাঁর সিন্ডিকেটের কাছে টেক্সটাইল মালিকরা যেমন অসহায়, তেমনি স্পিনিং মিলের মালিকরাও জিম্মি। গত দেড় দশক ধরে সিন্ডিকেট করে সুতার দাম নিয়ন্ত্রণ করে একচেটিয়া মুনাফা করছেন লাক মিয়া। এর ফলে টেক্সটাইল মিল মালিকরা ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি অনেক স্পিনিং মিল রুগ্ণ হয়ে পড়েছে। ভাড়ায় সেসব স্পিনিং মিলের কর্তৃত্ব নিয়ে সুতার মাফিয়ায় পরিণত হয়েছেন লাক মিয়া। নিজের প্রতিষ্ঠান সালমা ট্রেডার্সের মাধ্যমে একাই পরিচালনা করছেন কমবেশি ২৫টি স্পিনিং মিল।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপক বলেন, লাক মিয়ার কাছ থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠান তুলা ক্রয় করত। চেকের মাধ্যমে সেই টাকা লেনদেন হতো। তাঁর সঙ্গে ব্যবসা নিয়ে মতবিরোধ হলে তিনি আমাদের বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার চেক ডিজঅনারের মামলা করেন। ওই মামলা তুলে নেওয়ার জন্য দাবি করা এক কোটি টাকা রেজিস্ট্রি করে পরিশোধ করা হয়। কিন্তু আজও তিনি মামলা তুলে নেননি। উল্টো আমাদের হয়রানি করছেন। আমাদের মতো বহু ব্যবসায়ী লাক মিয়ার হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

ছোট বিনাইচর গ্রামের কামাল মিয়া বলেন, রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছেন লাক মিয়া। এমপি বাবুর ক্ষমতা তাঁকে আলাদীনের চেরাগ পাইয়ে দিয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকা কামিয়েছেন। এই টাকায় মানুষের রক্ত আর চোখের পানি লেগে আছে। আমরা তাঁর বিচার চাই।

ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ওসমান গনি বলেন, আওয়ামী এমপি বাবুর ক্যাশিয়ার ছিলেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। এমপির অবৈধ টাকায় লাক মিয়ার ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠে। বনে যান হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। সেই টাকা ব্যবহার করে এমপি বাবু ও লাক মিয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের অত্যাচার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমনে ব্যবহার করেছেন। এসব অবৈধ টাকা উদ্ধার করে তাঁর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি জানাচ্ছি।

ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের মহাব্যবস্থাপক লুত্ফর রহমান জানান, লাক মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ১০টি স্পিনিং মিল রয়েছে। এ ছাড়া তিনি ভাড়ায় অন্তত ১৪টি স্পিনিং মিল পরিচালনা করেন। একই সঙ্গে তিনি তুলা ও সুতার ট্রেডিং ব্যবসা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভার কয়েক শ কোটি টাকা।

তবে এসব শিল্প-কারখানা নির্মাণে বিপুল টাকার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি যতটুকু শুনেছি তিনি ব্যবসা করেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। বড় শিল্প-কারখানা গড়তে অনেক জমির প্রয়োজন হয়। এতে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

মন্তব্য

ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে লাক মিয়ার স্পিনিং মিল

ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
শেয়ার
ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে লাক মিয়ার স্পিনিং মিল
আড়াইহাজারে ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে গড়ে উঠেছে লাক মিয়ার ভাই ভাই স্পিনিং মিলস। ছবি : সংগৃহীত

একসময় ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পালতোলা নৌকা চলত। এসব নৌকায় স্থানীয় কৃষকের পাট আর তাঁতিদের কাপড় দেশের দূর-দূরান্তে পরিবহন করা হতো। নদে ছিল প্রবল স্রোত। নদে ধরা পড়ত নানা প্রজাতির বিপুল মাছ।

নদের পানি কৃষকরা তাঁদের সেচকাজে ব্যবহার করতেন। কিন্তু এখন সেসব শুধুই অতীত।

মৃতপ্রায় এই নদের নাম পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ব্রহ্মপুত্র নদের কয়েক কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকা ভরাট করে স্পিনিং মিল নির্মাণ করেছেন চিহ্নিত ইউপি চেয়ারম্যান লাক মিয়া।

এতে নাব্য হারিয়ে হুমকির মুখে পড়েছে নদটির অস্তিত্ব। স্থানীয় সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর প্রভাবে বেপরোয়া লাক মিয়ার ভয়ে স্থানীয় লোকজন এমনকি স্থানীয় প্রশাসনও বিষয়টি দেখেও না দেখার ভাণ করেছে। নোটিশ দিয়েও নদ থেকে উচ্ছেদ করা যায়নি লাক মিয়ার স্থাপনা। ফলে ক্রমে ব্রহ্মপুত্র নদের সীমানা ও গতি পরিবর্তনের পাশাপাশি পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

লাক মিয়া ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। তাঁর বিরুদ্ধে আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী ও রাজধানীর ভাটারা থানায় হত্যা, অস্ত্র, চেক জালিয়াতিসহ অন্তত ৯টি মামলা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি লাক মিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুই দিনের রিমান্ডে নেন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁকে আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে লাক মিয়া কারাগারে রয়েছেন।

স্থানীয়রা জানায়, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি একসময় নরসিংদী সদর, মাধবদী ও আড়াইহাজার এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি ছিল। যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিরাট ভূমিকা ছিল এ নদের। পাশাপাশি নদের দুই পারের কৃষিজমি ছিল ফসলে ভরা, পানিতে ছিল প্রচুর দেশি প্রজাতির মাছ।

জানা গেছে, আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের বিনাইরচর গ্রামে ২০১২ সালে চেয়ারম্যান লাক মিয়া ব্রহ্মপুত্র নদের একটি অংশে বালু ভরাট করে ভাই ভাই স্পিনিং মিলের অংশবিশেষ নির্মাণ করেন। শুধু নদ দখল নয়, মিলটি নির্মাণের সময় নদের তীরের কয়েক শ গাছ কেটে ফেলা হয়। বাঁশের খুঁটি পুঁতে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু ভরাট করে নদ দখল করে লাক মিয়া। পরবর্তী সময়ে সেখানে মিলের পুরো স্থাপনা নির্মাণ করা হয়।

২০১২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উপসচিব (মাঠ প্রশাসন, শৃঙ্খলা অধি-শাখা) মো. শাহ আলম নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসককে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আড়াইহাজার উপজেলা ভূমি কার্যালয় ও ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয় যৌথভাবে নদের তীর ও সংলগ্ন এলাকায় জরিপ চালায়। জরিপে নদ ও তীরবর্তী সরকারি আরএস ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত ৫০১ দাগে ৬৬.৭৫ শতাংশ জায়গা দখলে নিয়ে মিলের দেওয়াল, বিদ্যুতের সাবস্টেশন, আধাপাকা মিলঘর, পাওয়ার হাউস ভবন নির্মাণের প্রমাণ পাওয়া যায়।

জরিপের পরিপ্রেক্ষিতে নদের জায়গা থেকে অবৈধ স্থাপনা সরিয়ে নিতে ভাই ভাই স্পিনিং মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক লাক মিয়াকে ২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ও ২০ ফেব্রুয়ারি দুই দফায় নোটিশ দেওয়া হয়। পরে জেলা প্রশাসন একটি উচ্ছেদ মামলা করে। সর্বশেষ জেলা প্রশাসনের পক্ষে রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) রহিমা খাতুন ২০১৩ সালের ৬ মে লাক মিয়াকে চূড়ান্ত নোটিশ দেন। নোটিশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে দখল করা জমি সরকারের অনুকূলে হস্তান্তর ও যাবতীয় স্থাপনা অপসারণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরও মিলটি সরিয়ে নেওয়ার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বরং নোটিশ পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান লাক মিয়া তাঁর জবাব না দিয়ে উল্টো উপজেলা ভূমি অফিসের তৎকালীন কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি জেলা প্রশাসন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, স্পিনিং মিলের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। নদের কয়েক কিলোমিটার তীরবর্তী এলাকা ভরাট করে দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ভাই ভাই স্পিনিং মিল। নদী দখল করে মিল নির্মাণ করায় অন্য অংশের তুলনায় এখানে অনেকটা সরু হয়ে পড়েছে। ফলে নদে নেই পানিপ্রবাহ। পুরো নদজুড়ে কচুরিপানা ছড়িয়ে রয়েছে। কেমিক্যালের পানির কারণে নদীর পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

নদীর পারেই ফসলি জমিতে কাজ করছিলেন পাঁচগাঁও চরপাড়া গ্রামের মাসুদ রানা। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, এই নদ অনেক বড় ছিল। এখন সেই নদের পার দখল করে চেয়ারম্যান লাক মিয়া মিল করেছেন। মিলের ময়লা-আবর্জনা ফেলছে নদে। এ কারণে নদটি মরে গেছে। যে নদে আমরা ছোটবেলায় মাছ ধরতাম, এখন মাছ ধরা কেন, পানিতে নামাও যায় না।

আরেক কৃষক গুলজার হোসেন বলেন, চেয়ারম্যান লাক মিয়া নদীর ৪০ থেকে ৫০ ফুট দখল করেছে। কয়েক বছর আগে এই জায়গা উদ্ধার করতে প্রশাসনের লোকজন এসেছিল, একটু ভেঙেই উপর মহলের নির্দেশে চলে যায়। তারা টাকা ও ক্ষমতা দিয়ে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছে।

ছোট বিনাইরচর গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, প্রশাসনের নাকের ডগায় নদ ভরাটের ঘটনা ঘটলেও দখলদার প্রভাবশালী ও ধনী হওয়ায় প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

উজান গোবিন্দী বাঁশতলা ঘাটের দোকানদার রাসেল ভূইয়া বলেন, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে বাঁশতলা ঘাটে একসময় ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ মেলা বসত। লাক মিয়া নদ দখল করে ফেলায় সেই মেলা বন্ধ হয়ে গেছে। নদের বিরাট অংশ ভরাট করে ফেলায় নদের গতিপথ ও সীমানা পরিবর্তন হয়ে গেছে।

নদ দখল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ভাই ভাই স্পিনিং মিলসের মহাব্যবস্থাপক লুত্ফর রহমান বলেন, আমাদের মিলে নদী বা সরকারি জমি নেই। আর প্রশাসনের নোটিশের বিষয়ে আমার জানা নেই।

জানতে চাইলে আড়াইহাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, চেয়ারম্যান লাক মিয়ার নদী দখলের বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

মন্তব্য

‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়া

সুমন বর্মণ, আড়াইহাজার থেকে ফিরে
সুমন বর্মণ, আড়াইহাজার থেকে ফিরে
শেয়ার
‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়া

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের ছোট বিনাইচর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কুদরত আলী সরকারি চাকরিজীবী, আর ছোট ছেলে আবদুল মতিন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ১৮ শতাংশ কৃষিজমিই ছিল তাঁদের একমাত্র সম্বল। সেই জমিতে চাষাবাদ করে সংসার চালাতেন লাল মিয়া।

একসময় সেই জমিতে চোখ পড়ে ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়াগডফাদার লাক মিয়ার। জমি দখল করতে রাতের আঁধারে কৃষক লাল মিয়ার পরিবারের ওপর হামলা চালায় লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনী। কুপিয়ে গুরুতর জখম করে শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল মতিনকে। একমাত্র সম্বল কৃষিজমিটি হারানোর দুঃখ নিয়ে মারা গেছেন কৃষক লাল মিয়া।

তাঁর মতো নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের হাজারো মানুষের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়েছেন স্থানীয় সাবেক এমপি নজরুল ইসলাম বাবুর ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী গডফাদার চেয়ারম্যান লাক মিয়া। ক্ষমতার অপব্যবহার, নিরীহ মানুষের জমি দখল, নদী দখল করে শিল্প স্থাপন, মাদক কারবারসহ অসংখ্য অপকর্মে জড়িয়েছে তাঁর নাম। লাক মিয়া একা নন, এমপি বাবুর প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেধাবী এক ছাত্রীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করেন।

লাক মিয়া ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের সীমাহীন অত্যাচার থেকে বাঁচতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন আড়াইহাজারের সাধারণ মানুষ।

আড়াইহাজার উপজেলার উজান গোবিন্দ গ্রামের দিনমজুর ছাবেদ আলীর ছেলে লাক মিয়া। ছয় ভাইয়ের সংসারে অভাব অনটনের মধ্যে বড় হন লাক মিয়া। বড় ভাইয়ের হাত ধরে তাঁতের ব্যবসা দিয়ে তাঁর শুরু হলেও অভিযোগ রয়েছে, একচেটিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে আড়াইহাজারের তাঁতশিল্পকে ধ্বংস করেছেন লাক মিয়া ও তাঁর ভাইয়েরা। দাদন দিয়ে তাঁরা তাঁতকল ভাড়া নিয়ে একসময় সেই কারখানা দখল করে নিতেন।

এভাবে তাঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পুঁজি হারিয়ে ব্যবসা ছেড়েছেন অনেক তাঁত ব্যবসায়ী।

‘এমপি’ বাবুর মদদে বেপরোয়া লাক মিয়া২০০৮ সালে নজরুল ইসলাম বাবু আড়াইহাজারের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তাঁর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে লাক মিয়ার। আওয়ামী রাজনীতি না করেও হয়ে ওঠেন এমপি বাবুর ঘনিষ্ঠজন। ২০১৩ সালে এমপি নজরুল ইসলাম বাবুকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন লাক মিয়া। এমপি বাবুর প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করে পুরো ইউনিয়নবাসীকে জিম্মি করে লাক মিয়া গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এই বাহিনীর সহায়তায় তাঁর স্পিনিং মিলের পরিধি বাড়াতে নিরীহ মানুষের বাড়িঘর, জমি দখল করে নেন। তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস পাননি কেউ। কেউ প্রতিবাদ করলে ধরে এনে বিচারের নামে চালানো হতো নির্যাতন। মামলা দিয়ে করা হতো হয়রানি। গত ১৬ বছরে স্পিনিং মিলের বেশ কয়েকটি ইউনিট বাড়ান লাক মিয়া।

অবৈধ টাকার দাপটে টানা তিনবার ব্রাহ্মন্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে সর্বশেষ দুবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এমপির দাপট আর সন্ত্রাসী বাহিনীর ভয়ে কেউ তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে সাহস পাননি।

আড়াইহাজার-ভুলতা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিনাইচর গ্রামের দুই পাশ ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার শিল্প-কারখানা ভাই ভাই স্পিনিং মিলস লিমিটেড। একে একে সড়কের দুই পাশে গড়ে তোলা হয়েছে জামান স্পিনিং মিলস লিমিটেড, লতিফা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, ও সাবেদ আলী স্পিনিং মিলস লিমিটেড-এর ১০টি ইউনিট। কয়েক শ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় চার লাখ স্পেন্ডেল।

স্থানীয়রা জানায়, নিরীহ মানুষের জমি ও ব্রহ্মপুত্র নদ দখল করে গত দেড় দশকে গড়ে তোলা হয় এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান। আওয়ামী নেতা হওয়ায় সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসন ছিল অসহায়। লাক মিয়া বনে যান এই এলাকার অঘোষিত ভূপতি। তবে অভিযোগ আছে, এসব মিল-কারখানার বেশির ভাগ জমি দখল করেছেন তিনি। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও লাক মিয়ার ক্ষমতায় সামান্য আঁচড় লাগেনি। অভিযোগের পাহাড় জমলেও কেউ কথা বলার সাহস করছেন না।

২০০৪ সালের দিকে লাক মিয়া ও তাঁর ভাই হক মিয়া বিনাইচরে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। কারখানার অদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের পারে ১৫ শতাংশ জমিতে ছিল কৃষক জুলহাস মিয়ার ফসলি জমি ও বাড়ি। ছয় সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তাঁর বাস। সেই জমিতে নজর পড়ে লাক মিয়ার ভাই হক মিয়ার। জমি দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে দেওয়া হয় ধর্ষণের হুমকি। ওই হুমকি উপেক্ষা করে কিছুদিন থাকতে পারলেও এক রাতে ২০ থেকে ৩০ জনের একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। হামলাকারীরা এক দিনের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে আলটিমেটাম দেয় জুলহাস মিয়াকে। না হলে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। শেষে বাধ্য হয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভিটেবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন কৃষক জুলহাস মিয়া। আদি পেশা ছেড়ে বর্তমানে কালীবাড়ি বাজারে পান-বিক্রি করে জীবন ধারণ করছেন তিনি। সহায় সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হলেও প্রাণভয়ে কথা বলেননি জুলহাস মিয়া।

লাক মিয়ার স্পিনিং মিলের পাশে উজান গোবিন্দী বাঁশতলা ঘাট। সেখানকার মোড়ে রাসেল ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কথা হয় মালিক রাসেল ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, মিলের ভেতরে তাঁদের পৈতৃক ২০ বিঘা জমি রয়েছে। সেই জমি জোর করে দখল করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। এই জমি হারিয়ে তাঁরা নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। লাক মিয়া মানুষের ওপর যে অত্যাচার করেছেন তা বর্ণনা করার ভাষা নেই রাসেলের।

তাঁর পাশেই কথা হয় রতন ডেকোরেটরের মালিক রতন ভূঁইয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, লাক মিয়া আমাদের ২৫ শতাংশ জমি দখলের চেষ্টা করেছেন। আমি বাধা দেওয়ার পর এমপি বাবু আমাকে হুমকি দিয়েছেন। সরকারি জমিতে আমার একটু ঘর পড়েছিল, তা ভাঙিয়েছেন। অথচ লাক মিয়া একই সরকারি জমি দখল করে বাউন্ডারি দিয়েছেন। তাঁদের ক্ষেত্রে কোনো আইন নেই। যত আইন আমাদের জন্য।

লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনীর হামলায় আহত হওয়ার পর থেকে আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না ছোট বিনাইচর গ্রামের শারীরিক প্রতিবন্ধী আবদুল মতিন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ২০ শতাংশ জমিই ছিল আমাদের পরিবারের একমাত্র সম্বল। সেই জমিতে চাষবাস করে দুই ভাই এক বোনের সংসার চালিয়েছেন বাবা। কারখানা করতে সেই জমিতে নজর পড়ে চেয়ারম্যান লাক মিয়ার। জমি দখল করতে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালান। সবাইকে কুপিয়ে আহত করেন। মরে গেছি ভেবে আমাকে ফেলে যান। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরও আমি ভালো (সুস্থ) হতে পারিনি। এ কারণে বিয়েও করা হয়নি।

সুলতান সাদী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মনজুর মিয়া বলেন, পশ্চিম সরাবদী গ্রামে আমাদের একটি বাড়ি ছিল। বালি ফেলে জোর করে সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে লাক মিয়ার লোকজন। আজও আমি সেই জমির টাকা পাইনি।

শুধু আড়াইহাজার নয়, পাশের রূপগঞ্জের সাধারণ মানুষও চেয়ারম্যান লাক মিয়ার ছোবল থেকে রক্ষা পায়নি। উপজেলার মর্তুজাবাদ এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করেন লাক মিয়া। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আফজাল, ছাত্রলীগ, যুবলীগ দিনে বাড়িঘর ছাড়ার হুমকি দিত আর রাতে পরিবারের নারীদের ওপর চালাত অত্যাচার। শিউরে ওঠার মতো সেসব ঘটনা। জোর করে ঘরে বসাত মদের আসর। প্রতিবাদ করলে নেমে আসত নির্মম নির্যাতন।

এক রাতেই দখল করে নেওয়া হতো আশপাশের জমি। মানুষের জমির ছোট ছোট বাউন্ডারি গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি করা হতো সীমানাপ্রাচীর। মাঝখানে টাঙানো হতো লাক মিয়ার ভাই ভাই স্পিনিং মিলের সাইনবোর্ড।

একজন ভুক্তভোগী পারভিন আক্তার জানান, তাঁর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল নিজের একটি বাড়ি হবে। আর সেই বাড়িতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকবেন। তাই দিন-রাত মশারি কারখানা ও মেস-বাড়িতে কাজ করে নিজের একটি বাড়ি তৈরি করেছিলেন। তবে এই বাড়িই কাল হয়ে দাঁড়ায় তাঁর জন্য। লাক মিয়ার শকুনের নজর পড়ে ওই বাড়িতে। লাক মিয়ার সন্ত্রাসী বাহিনীর অত্যাচারে শেষ পর্যন্ত ওই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন পারভিন আক্তার।

লাক মিয়ার মতো এমপি বাবুর প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। লাক মিয়ার ভাতিজা নাঈম হাসান সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া মেধাবী এক ছাত্রীকে ২০১২ সালের ৭ এপ্রিল স্কুলে যাওয়ার পথে অস্ত্রের মুখে রাস্তা থেকে অপহরণের পর ধর্ষণ করেন। ওই মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয় ধর্ষক নাঈম হাসানের। ওই মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত বছর সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্ত হন নাঈম। কারাগার থেকে বেরিয়েই বর্তমানে এলাকায় তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে প্রতিদিন মোটরসাইকেলে শোডাউন দিচ্ছেন। এই সন্ত্রাসী বাহিনীর আতঙ্কে অনেক ছাত্রী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, চেয়ারম্যান লাক মিয়া আড়াইহাজার উপজেলায় মাদক কারবারের বিস্তার ঘটিয়েছেন। তাঁর এই মাদক কারবার দেখভাল করেন সোহেল মেম্বার। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত মাদক কারবারি। লাক মিয়ার ভাইদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিলেন বড় ভাই জয়নাল আবেদীন। জায়গা দখল করতে গেলে এক নারী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে জুতাপেটা করেন। ওই লজ্জায় হার্ট অ্যাটাক করে পরে মারা যান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের এক মামলায় কিছুদিন আগে গ্রেপ্তার করা হয় লাক মিয়াকে। তবে ২০২৩ সাল থেকে তিনি সাজাপ্রাপ্ত আসামি। এই সাজা মাথায় নিয়ে থানা পুলিশের সামনে দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়াতেন লাক মিয়া। তাঁর বিরুদ্ধে আড়াইহাজার, নরসিংদীর মাধবদী ও রাজধানীর ভাটারা থানায় হত্যা, অস্ত্র, চেক জালিয়াতিসহ অন্তত ৯টি মামলা রয়েছে। চেক জালিয়াতির মামলায় লাক মিয়া এক বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, সাবেক এমপি বাবুর ক্যাশিয়ার ছিলেন চেয়ারম্যান লাক মিয়া। লাক মিয়া বিগত সময়ে এলাকায় যে অপকর্ম করেছেন এবং মানুষকে হয়রানি ও জুলুম করেছেন, এ বিষয়ে নির্যাতিতরা অভিযোগ করলে আমরা মামলা গ্রহণ করব। এ ছাড়া লাক মিয়ার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো অবস্থাতেই লাক মিয়া যাতে আইনের বাইরে যেতে না পারেন সে বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে।

 

 

মন্তব্য
সাংবাদিকদের জামায়াত আমির

আপনার ভাষা ও কৌশলে আমাদের সমালোচনা করুন

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
আপনার ভাষা ও কৌশলে আমাদের সমালোচনা করুন
শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, রাজনীতির স্লোগান যদি সত্যিই হয়—‘আমার চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়, তাহলে দেশের স্বার্থকেই সবার আগে গুরুত্ব দেওয়ার কথা। কিন্তু রাজনীতিকরা তাঁদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটি বাস্তবে প্রমাণ করতে পারেননি।

গতকাল শুক্রবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) ইফতার মাহফিলে এসব কথা বলেন জামায়াতের আমির।

জামায়াত আমির বলেন, দুই ধরনের স্টেকহোল্ডার সমাজকে ফোর-ডি ভিশনে দেখেন।

এক. সাংবাদিকরা; দুই. রাজনীতিকরা। এই দুইয়ের যেকোনো একটিতে স্বচ্ছতার অভাব হলে সে সমাজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে, দৌড়ে সামনে যেতে পারে না। বাংলাদেশের অবস্থা বাস্তবে এমনই। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিবিদদের আত্মসমালোচনা করা জরুরি।
পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মীদেরও সত্য প্রকাশে বুক টান করে দাঁড়াতে হবে।

সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি আরো বলেন, আমরা যদি কোনো ভালো কাজ করি, তাহলে আপনারা প্রশংসা করবেন কি না সেটা আপনাদের ব্যাপার। কিন্তু সমালোচনা করতে ভুলবেন না। আপনার ভাষা ও কৌশলে আমাদের সমালোচনা করুন।

তবে সব কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে দেশের স্বার্থকে বিবেচনায় রাখুন।

তিনি আরো বলেন, সংবাদপত্রের দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো নিউজ, আরেকটি ভিউজ। নিউজ হুবহু উপস্থাপন করুন, আর ভিউজে আপনার ইচ্ছা তুলে ধরুন। যে গ্রহণ করবে সে করবে, আর যে করবে না সে করবে না।

কিন্তু নিউজ পরিবর্তন করা হলে বক্তব্য প্রদানকারীর প্রতি সুবিচার করা হয় না। আমি নিজেও মাঝেমধ্যে এমন অবিচারের শিকার হই। আমাদের শুধু মন্দ দিক নয়, ভালো দিকও তুলে ধরুন। তাহলে ভালো দেখে কেউ উদ্বুদ্ধ হবে, আর খারাপ দেখে সতর্ক হবে।

ডিআরইউর সভাপতি আবু সালেহ আকনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেলের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত এই ইফতার মাহফিলে আরো উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহীদুল ইসলাম প্রমুখ।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ