জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখা যায় তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। এর থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো টেকসই অর্থনৈতিক সংস্কার। এই সংস্কার এক-দুই দিনের জন্য নয়, একটি দীর্ঘমেয়াদি রোডম্যাপ করে এগোতে হবে। বর্তমানে দেশের দায়িত্ব হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
আর্থিক খাতে কী ধরনের সংস্কার প্রয়োজন
- আনোয়ার হোসেন, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত খবর

সংস্কারে স্বপ্নের আগামী


অপার সম্ভাবনার শ্রমবাজার : প্রয়োজন যেসব সংস্কার
- শেখ রফিকউজ্জামান, শিক্ষার্থী, রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

দুচোখে স্বপ্ন এবং বুকভরা এক আকাশ পরিমাণ আশা নিয়ে নিজ মাতৃভূমি, মা-বাবা, পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব ফেলে হাজার মাইল দূরের অজানা দেশের উদ্দেশে পাড়ি জমানো। উদ্দেশ্য পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা আনা এবং একটু ভালো ও উন্নত জীবন লাভ করা। কারো গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের স্বপ্নপুরী সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন কিংবা ওমান। কেউ বা যাচ্ছেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতায় মোড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ কিংবা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড।
অর্থনীতিতে প্রবাসীদের অবদান খুব উচ্ছ্বসিতভাবে পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেও বাংলাদেশের শ্রমবাজার এবং রেমিট্যান্স খাতের ইতিবাচক সংস্কারের তাড়না তেমন একটা দেখা যায় না। যেমন ধরুন, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোনো যুবক যদি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় তাহলে তাকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। আবেদন করা থেকে শুরু করে ভিসা পেয়ে বিমানে ওঠা পর্যন্ত পদে পদে সিন্ডিকেট এবং অর্থদণ্ড।
আমাদের জনসম্পদকে ফ্রি ভিসার ফাঁদ থেকে রক্ষা করতে হবে। এক শ্রেণির অসৎ স্বার্থন্বেষী দালালচক্র, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের ফ্রি ভিসার লোভ দেখিয়ে সহজ-সরল প্রবাসীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে ভুল বুঝিয়ে তাঁদের বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর অচেনা পরিবেশের অথই জলে ভাসতে থাকা অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এবং অদক্ষ প্রবাসী শ্রমিকটি বিদেশে মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন এবং বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর ভূমিকা অনেকটা বিমাতাসুলভ। প্রবাসীদের বিপদে কিংবা কোনো প্রয়োজনে সেই দেশে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাস ঠিকমতো দায়িত্বশীল ও অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। কাজে দীর্ঘসূত্রতা, ভোগান্তি এবং অবকাঠামোগত সংস্কারহীনতা যেন দূতাবাসগুলোর চিরাচরিত রূপ।
শ্রমিকদের বাংলাদেশ থেকে পাঠানোর আগে সরকারিভাবে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার প্রয়োজনীয়তা আছে। নামকাওয়াস্তে স্বল্প কিছু গুচ্ছ কোর্স নয়, বরং ছয় মাস থেকে এক বছর মেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন দক্ষতামূলক কাজ; যেমন—গাড়ি চালানো, উন্নত প্রযুক্তি চালানো, ভোকেশনাল ট্রেনিং, রন্ধনশিল্প, যোগাযোগের জন্য ন্যূনতম ইংরেজি এবং যে দেশে যাবেন সেই দেশের ভাষা সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া, মহিলাদের ক্ষেত্রে গৃহস্থালির কাজ সামলানো ইত্যাদি ট্রেনিং। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ, যেমন—ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের যদি তুলনা করি তাহলে বাংলাদেশিদের মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যেতে খরচ দুই থেকে তিন গুণ বেশি লাগে। কখনো কখনো সেটা বেড়ে চার-পাঁচ গুণও হয়। প্রবাসীদের ব্যাপারে গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দর-কষাকষি বরাবরই স্বার্থবিরুদ্ধ একপক্ষীয় এবং খুবই ভঙ্গুর। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের ভিসা পেতে আমাদের পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ঐকান্তিক চেষ্টায় ইউরোপের অনেক দেশ ঢাকায় তাদের ভিসা সেন্টার খুলেছে। বাংলাদেশের অফুরন্ত শ্রমবাজার গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি দারুণ ‘বার্গেনিং টুল’ হতে পারে। ভিসা নবায়ন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ‘আকামা’ জটিলতা নিরসন, কর্মস্থলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, প্রাপ্য বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসহ সব অধিকার, নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তা, যেসব শ্রমিক বিদেশের মাটিতে মারা যান তাঁদের মৃতদেহ কিভাবে খুব সহজে দেশে আনা যায় সে ব্যাপারে এবং কিভাবে বাংলাদেশ খুব সহজে বিপুল পরিমাণ অভিবাসী পাঠাতে পারে সে ব্যাপারে কূটনৈতিক দর-কষাকষির এখনই উপযুক্ত সময়। এ ছাড়া ইচ্ছাকৃত বা জোরপূর্বক শ্রমিক দেশে পাঠানোর ব্যাপারে গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমতাভিত্তিক দীর্ঘস্থায়ী সমঝোতার ব্যবস্থা করতে হবে।
একজন অভিবাসী তাঁর সারা জীবন কষ্ট করে জীবনের এক পর্যায়ে অবসর নিয়ে দেশে ফেরেন যখন, তখন দেখা যায়, অনেকেই নিঃস্ব এবং সহায়-সম্বলহীন হয়ে যান। জীবনের বাকি সময়টুকু সুখে কাটানোর মতো তেমন বিশেষ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। এ রকম পরিস্থিতিতে পড়া বা যাঁরা অকালে প্রবাস থেকে চলে আসেন তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা এবং শুধু একান্তই ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের জন্য সরকারের একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া যথাযথভাবে এর বাস্তবায়ন করতে হবে, প্রয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ যাতে কেউ নয়ছয় করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারের কঠোর আইন প্রণয়ন করা একান্ত জরুরি।
নতুন বাংলাদেশে সবাই নতুন করে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। আমাদের রেমিট্যান্স ফাইটাররাও অপার আশার আলোয় বুক বেঁধেছেন। সব শেষে এইটুকুই প্রত্যাশা করি, আমাদের রেমিট্যান্স ফাইটার ভাই-বোনদের চাপা আর্তনাদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল পর্যন্ত পৌঁছবে। সেই সঙ্গে এটাও বিশ্বাস করি, রাষ্ট্র অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রবাসীদের স্বার্থকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে বিশ্বের বুকে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করার দৌড়ে শামিল হবে।

শ্রমবাজার
চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক প্রস্তুত করুন
- আল-আমিন নয়ন, ম্যানেজার, ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার

অভিবাসনপ্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও শ্রমিকদের দক্ষতার অভাবে বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মীদের জন্য বেশ কিছু শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। বন্ধ থাকা শ্রমবাজারগুলো পুনরায় চালু করতে সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার চালু করতে হবে। নতুন শ্রমবাজারের জন্য প্রথমে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি ও উন্নয়ন করা প্রয়োজন।

দক্ষ শ্রমিক প্রস্তুতে পেশাগত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এর জন্য বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ অর্থাৎ নির্মাণ, নার্সিং, কৃষি ও তথ্য-প্রযুক্তি খাতে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে গন্তব্য দেশের ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণের পর কর্মীদের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মানের প্রশিক্ষণ সনদ প্রদান করতে হবে।
শুধু প্রশিক্ষণেই থেমে থাকলে চলবে না, নতুন বাজারের জন্য চাই গবেষণা। বিশ্বজুড়ে নতুন শ্রমবাজার চিহ্নিত করার জন্য একটি গবেষণাদল তৈরি করা প্রয়োজন। এই দলটি কোন দেশে শ্রমিকের চাহিদা বেশি তা নির্ধারণ করবে। যেসব দেশে ভবিষ্যতে শ্রম চাহিদা বাড়বে, সেগুলোর দিকে দলটি নজর রাখবে। যেসব দেশে উৎপাদনশীল শিল্প ও নির্মাণ খাতে চাহিদা বেশি সেগুলোতে যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে।
প্রশিক্ষণ ও গবেষণাদলের পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর জন্য নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সহজ করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। নতুন শ্রমবাজার খুলতে হলে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে চুক্তি বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য দেশে ও বিদেশে আইনগত সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। নতুন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে শ্রমিক পাচারের ঘটনা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য অনিবন্ধিত বা ভুয়া এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাশাপাশি মানবপাচারবিরোধী আইন কার্যকর করতে হবে। নতুন বাজারের সম্ভাব্য নিয়োগদাতাদের বাংলাদেশি শ্রমিকদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়ে অবহিত করতে হবে।
দ্বিপক্ষীয় চুক্তি পুনরুদ্ধার ও বন্ধ বাজারগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উচ্চ পর্যায়ের সরকারি বৈঠক আয়োজন করা প্রয়োজন। নিয়োগসংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো পুনর্বিবেচনা করা এবং সংশোধনের মাধ্যমে উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। এর জন্য অভিবাসনপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি কর্মী নিয়োগে মধ্যস্বত্বভোগী ও অবৈধ দালালচক্র নির্মূল করতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর অনলাইনভিত্তিক স্বচ্ছ রেজিস্ট্রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন এবং সুনির্দিষ্ট দক্ষতা উন্নয়ন প্রগ্রাম চালু করতে হবে। বিদেশি নিয়োগদাতাদের চাহিদা অনুযায়ী ভাষা, প্রযুক্তি ও পেশাগত দক্ষতা প্রদান করতে হবে। বিদেশে পাঠানোর আগে কর্মীদের কাজের শর্ত, বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে কর্মীরা তাঁদের অধিকার রক্ষা করতে পারেন। বৈদেশিক শ্রমবাজারে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। শ্রমবাজারগুলোতে বাংলাদেশের কর্মীদের ইতিবাচক চিত্র তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাবশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যাঁরা সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন, তাঁদের উদাহরণ দিয়ে বাজারগুলোতে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃস্থাপন করা সম্ভব। সরকার যদি উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে, তাহলে বন্ধ থাকা শ্রমবাজার পুনরায় চালু করার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে নতুন শ্রমবাজার খোঁজার মাধ্যমে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং প্রবাসী শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হবে। এর ফলে আমাদের রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সপ্রবাহ সাম্প্রতিক সময়ের তুলনায় স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। ২০২৩ সালের শেষের দিকে এবং ২০২৪ সালের শুরুর পূর্বাভাস অনুসারে, বার্ষিক রেমিট্যান্সপ্রবাহ ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা, ডলারের বিনিময় হার সমন্বয় এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের কার্যক্রম উন্নত হওয়ার ফলে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বাড়ছে। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর অনুপ্রেরণায় এই প্রবাহ ইতিবাচক দিক দেখাচ্ছে। তবে কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান; যেমন—হুন্ডি চ্যানেলের প্রতিযোগিতা এবং আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতা। ফলে রেমিট্যান্সপ্রবাহে উল্লেখযোগ্য উন্নতি নিশ্চিত করতে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হুন্ডি ব্যবসা (অবৈধ অর্থ লেনদেনের একটি প্রথাগত পদ্ধতি) বন্ধ করতে হবে।
হুন্ডি ব্যবসা এখনো জনপ্রিয় থাকার পেছনে কয়কটি কারণ রয়েছে। সরকার বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রণোদনা দিলেও অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোকে সহজ ও সুবিধাজনক মনে করেন। এর কারণ হচ্ছে, সহজ ও দ্রুত প্রক্রিয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো যায়; এবং অনেক ক্ষেত্রেই তা তাৎক্ষণিক। ব্যাংক বা মানি এক্সচেঞ্জের মতো প্রক্রিয়ায় অনেক সময় প্রয়োজন হয় এবং নথিপত্র জমা দিতে হয়, যা অনেকের জন্য ঝামেলার মনে হয়। বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসীরা অনেক সময় বেশি বিনিময় হার পান। সরকার নির্ধারিত রেটের তুলনায় বাজারের কালো রেট প্রায়ই বেশি থাকে, যা প্রবাসীদের আকর্ষণ করে। অনেক প্রবাসীর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই বা তাঁরা ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত নন। হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে কোনো আনুষ্ঠানিক অ্যাকাউন্টের প্রয়োজন হয় না। হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের ওপর আঞ্চলিক বা ব্যক্তিগতভাবে আস্থা থাকায় প্রবাসীরা এই পদ্ধতি বেছে নেন। এটি প্রায়ই পরিবারের সদস্য বা পরিচিতদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
সরকার বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে প্রণোদনা দিলেও তা অনেক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত নয়। প্রবাসীদের বড় অংশ মনে করেন, হুন্ডির মাধ্যমে তাঁরা দ্রুত এবং অধিক লাভজনক সুবিধা পান। অনেক প্রবাসী জানেন না যে হুন্ডি অবৈধ এবং অর্থনীতি ও দেশের ওপর এর কী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। সচেতনতার অভাবে তাঁরা এই পদ্ধতিকে স্বাভাবিক মনে করেন। এর জন্য প্রবাসীদের বৈধ উপায়ে অর্থ পাঠানোর উপকারিতা এবং হুন্ডির ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানাতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকার বিনিময় হার আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। কাগজপত্র বা সময়ের জটিলতা কমিয়ে সহজ ও দ্রুত লেনদেন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সহজ অ্যাপ এবং সেবাগুলো চালু করতে হবে। এটি একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা সমাধানের জন্য সরকারের পাশাপাশি প্রবাসী কর্মী এবং সাধারণ জনগণেরও সচেতন ভূমিকা প্রয়োজন।
আগামীর শ্রমবাজার শক্তিশালী করতে হলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অনলাইনে ভিসা আবেদন, বৈধ কাগজপত্র যাচাই এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রবাসীদের একটি ডিজিটাল ডেটাবেইস তৈরি করতে হবে। শ্রমিকদের অভিযোগ দ্রুত সমাধান করতে দূতাবাসের কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে হবে। নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র, আইনি সহায়তা এবং মানসিক সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, ও আফ্রিকায় নতুন শ্রমবাজার তৈরি করতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে। এর সঙ্গে প্রতিটি দেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক প্রস্তুত করতে হবে।

কেমন ব্যাংকিং খাত চাই
- মো. জোবায়েদ হোসেন, শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আমরা যে উচ্চ আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখি, বাংলাদেশকে সেই কাঙ্ক্ষিত উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন আর্থিক খাতের উন্নয়ন। আর্থিক খাতের বড় একটা অংশ জুড়ে আছে ব্যাংক খাত, যে খাতের উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, যে আর্থিক খাতের ওপর দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় একটা অংশ নির্ভর করছে, সেই আর্থিক খাতকেই শোষণযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বছরের পর বছর গুটিকয়েক মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে।
চলতি বছরের নভেম্বরে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় দুই লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতকে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারা অন্যান্য ব্যাংকের কার্যকলাপ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে।
ব্যাংক খাতের সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
সর্বোপরি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে আর্থিক খাতের ওপর সরকারের বিশেষ নজর দিতে হবে। তাহলেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত করা সম্ভব হবে।