<p>কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে হাসিমুখে বললেন, ‘ভেতরে আসুন।’ ঘরের তিন প্রান্তে সোফা সেট। সোফার বড় অংশজুড়ে কস্টিউম। বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না। গত রাতে জ্যাৎ নৃত্যের পরিবেশনা ছিল থোয়াইঙ্গ্যপাড়ায়। শিল্পীরা এসব কস্টিউম রেখে গেছেন। এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি।’</p> <p><img alt="মারমা গানের প্রাণ চ থুই ফ্রু" height="74" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.%20january/04-01-2025/8764.jpg" style="float:left" width="262" />এবার চা নিতে অনুরোধ করে বললেন, ‘এই সময়টায় রেওয়াজ করি।’ এই বলে হারমোনিয়ামটা কাছে টেনে নিলেন। দরাজ গলায় গাইলেন, ‘ও ক্যকচিং ম্রো:মা কোহ খস্যুগোলে...।’ অর্থ না বুঝলেও সুর দোলা দিয়েছে মনে। টের পেয়ে বললেন, ‘এখানে প্রেমিকার উদ্দেশে প্রেমিক বলছে—ও ক্যকচিং শহরের আমার প্রিয়া/আমি আছি অপেক্ষায়/এখানে সেখানে কত খুঁজেছি/একদিন না দেখলে মনে হয় বছর দেখি নাই/ও প্রিয়া তুমি কোথায়।’</p> <p>প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে গানের সঙ্গে মিতালি গড়া এই মানুষটার নাম চ থুই ফ্রু মারমা। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব। মারমাদের মধ্যে  অনেক জনপ্রিয় এই গানটির মতো ৯০টির বেশি মৌলিক গানের গীতিকার ও সুরকার তিনি। ১২টি অ্যালবাম আছে তাঁর। সুর করেছেন দেড় শতাধিক গানে। মারমা, চাকমা ও বাংলা—তিন ভাষার গানে সমান পারদর্শী। বান্দরবানের জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘চিম্বুক’-এর প্রতিষ্ঠাতা।</p> <p><strong>গ্রামোফোনে সুরেলা সকাল</strong></p> <p>জন্ম ১৯৬৫ সালে বান্দরবানে। বাবা হ্লা থোয়াই ফ্রু কাছ থেকে মারমা জাতিগোষ্ঠীর ভাষা, ঐতিহ্য, ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছেন। সংগীতের আবহে বড় হয়েছেন।</p> <p>পড়াশোনা শুরু ডন বক্সো স্কুলে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথম গান পরিবেশনের সুযোগ পেলেন। শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহর ‘আমার ছোট ভাইটি’ শিরোনামের ছড়াগান গেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে।</p> <p>প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হলেন বান্দরবান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথমবারের মতো হারমোনিয়াম বাজিয়ে গেয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীত। এরপর থেকে স্কুলের যেকোনো অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত চ থুই ফ্রুর। ১৯৮১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। তত দিনে ধ্রুপদী সংগীতের তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ শান্তিময় চক্রবর্তীর কাছ থেকে।</p> <p><strong>সাফ গেমসে</strong></p> <p>১৯৮১ সালে মারমা গান ও বাংলা ছড়ার ওপর প্রথমবারের মতো কোরিওগ্রাফি করেছিলেন। সেই সূত্রে ডাক পান সাফ গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয় আসরে থালা এবং সাংগ্রাই—৯ মিনিটের এই দুটি নাচে অংশ নিয়েছিল পাহাড়ের ৬০ জন তরুণী। কোরিওগ্রাফার ছিলেন চ থুই ফ্রু। বেশ প্রশংসিত হয় সেই পরিবেশনা। ১৯৯৩ সালেও সাফ গেমসে ১০০ জন নৃত্যশিল্পী নিয়ে প্রদর্শনী করেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের নাচের মুদ্রাগুলো কঠিন। আজকালের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা পারে না। আমিও আসলে নাচতে পারি না। তবে শিল্পীদের কাছ থেকে নাচের মুদ্রা ঠিকঠাক তুলে আনতে পারি।’</p> <p><strong>পাহাড়িকায় প্রথম</strong></p> <p>১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ বেতারের চট্টগ্রাম কেন্দ্র থেকে ডাক পেলেন চ থুই ফ্রু। তিনি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র। ‘পাহাড়িকা’ অনুষ্ঠানে নিজের লেখা ও সুরে একটা মারমা গান পরিবেশন করেন। বেতার কর্তৃপক্ষ আরো কয়েকজন মারমা শিল্পীর সন্ধান চাইল। খোঁজ নিতে গিয়ে চ থুই ফ্রু দেখলেন, মারমা গানের গীতিকার, সুরকার একেবারেই কম। লিখিত গানের সংখ্যাও হাতে গোনা। ভাবলেন, নিজেই গান লেখার চেষ্টা করবেন। মারমা গানের ধারা বেশ সমৃদ্ধ। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত সেটা মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। কোনো রেকর্ড করা হয়নি। সেই উদ্যোগ নেওয়া প্রথম ব্যক্তি চ থুই ফ্রু।</p> <p>১৯৯১ সালে তিনি স্নাতক পাস করে কালচারাল অফিসার হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটে। বললেন, ‘চাকরির কারণে মাস্টার্স করা হয়নি।’ অবশ্য চাকরিটা আশীর্বাদ হয়ে এলো। সংগীত সাধনায় পূর্ণ মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন।</p> <p><strong>পাহাড়ের প্রথম ব্যান্ড ‘চিম্বুক</strong><strong>’</strong></p> <p>মারমাদের ১৪ ধরনের লোকগান আছে। নব্বই দশকের আগ পর্যন্ত মারমা গান শুধু নিজেদের ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মারমা গানে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার তাঁর হাত ধরেই, যা তরুণ প্রজন্মকে নিজ সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। চ থুই ফ্রু বললেন, ‘শহরে যারা থাকে, তাদের বেশির ভাগই লোকজ বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজাতে পারে না। আবার আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে কষ্ট হয় প্রান্তিক মারমাদের।’ এই বিভেদ ঘোচাতে ১৯৯৩ সালে পাঁচজন তরুণকে নিয়ে গঠন করলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ব্যান্ড দল ‘চিম্বুক’। তাঁরা হলেন হ্লাসিংপ্র জর্জি, শৈটিংপ্রু, চাইসিংমং, পারখুম লুসাই ও থুই থুই প্রু। শুরুতে নানা সমস্যা থাকলেও পরে বেশ জনপ্রিয়তা পায় ব্যান্ডটি।</p> <p><strong>মারমা গানের প্রথম অ্যালবাম</strong></p> <p>১৯৯৬ সালে ২০ জন শিল্পীকে নিয়ে মারমা শিল্পীগোষ্ঠী গঠন করেন চ থুই ফ্রু। মারমা সংস্কৃতি, নাচ, গান, লোকজ আচার প্রচার করাই ছিল এই দলের উদ্দেশ্য। বর্তমান জাতীয় অনেক অনুষ্ঠানে এই শিল্পীগোষ্ঠীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখা যায়।</p> <p>চ থুই ফ্রুর উদ্যোগে ১৯৯৯ সালে মারমাদের ইতিহাসে প্রথম গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ‘তঙ্ অঙোয়ে্’ নামের সেই অ্যালবামে ছিল ১২ জন শিল্পীর ১৪টি গান ছিল। দেশে তো বটেই, মায়ানমারেও এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে এসব গান। মূলত এই অ্যালবামের মাধ্যমে তখন মারমা গানের নিজস্ব ধারা তৈরি হয় বলে জানালেন চ থুই ফ্রু। তিনি বলেন, ‘স্টুডিও ছিল না আমাদের। উজানিপাড়ার একটা ভাঙা ঘরে গানগুলো রেকর্ড করেছিলাম। গানগুলো এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাই।’ এই শিল্পীগোষ্ঠীর উদ্যোগে মারমা, ম্রো ও বম ভাষায় সাতটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।</p> <p>২০০২ সালের দিকে নিজ বাসার ছাদে একটা স্টুডিও তৈরি করেছেন চ থুই ফ্রু। সেখানে নিয়মিত পাহাড়ের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর গান রেকর্ড করা হচ্ছে।</p> <p><strong>নাচেও আছেন</strong></p> <p>শুধু গান নয়, নাচে নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরার ক্ষেত্রে মারমাদের জুড়ি মেলা ভার। এই নৃত্যও প্রাণ পেয়েছে চ থুই ফ্রুর হাতে। গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘ময়ূর নৃত্য, পাখা নৃত্য, ছাতা নৃত্য, মনোহরি নৃত্য, প্রজাপতি নৃত্য, প্রদীপ নৃত্য, থালা নৃত্য, পাখা নৃত্যসহ দেশে এখন মারমাদের যেসব নৃত্য হয় বলতে গেলে সবগুলোর কোরিওগ্রাফি আমার করা। এগুলোর মিউজিকও।’</p> <p>মারমা জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘সাংগ্রাইমা’র কোরিওগ্রাফারও তিনি। বললেন, ‘আমাদের নাচের মুদ্রা এবং মিউজিকগুলোর উপকরণ জ্যাৎ থেকে পাওয়া।’</p> <p>‘জ্যাৎ’ হচ্ছে মারমাদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী লোকসংস্কৃতি। আদিকালের রাজ-রাজরাদের জীবনধারা এবং ওই সময়ের সাধারণ মানুষের জীবনধারা, কৃষ্টি-কালচার ও কর্মসমূহকে সুর, তাল, লয়ের মাধ্যমে কোনো এক কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলাই হলো জ্যাৎ।</p> <p><strong>যা করতে চান</strong></p> <p>কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৪ সালে বান্দরবান শিল্পকল্পা একাডেমি থেকে ‘নৃত্য কোরিওগ্রাফার’ হিসেবে সম্মাননাসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সম্মাননা পেয়েছেন জেলা পরিষদ এবং বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল থেকেও। এখন নিয়মিত শিশু এবং তরুণদের গান-নাচ শেখান। বললেন, ‘মারমাদের লোকগানের সম্ভার অনেক সমৃদ্ধ। জ্যাৎ, পাংখুয়ের মতো লোকজ নাচের সংলাপগুলো যুযোপযোগী করার ইচ্ছা আছে।’</p> <p><img alt="মারমা গানের প্রাণ চ থুই ফ্রু" height="600" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.%20january/04-01-2025/12_kaler-kantho--4-1-2025.jpg" width="1000" /></p> <p>মারমাদের প্রথম অ্যালবাম ‘তঙ্ অঙোয়ে্’</p> <p><img alt="মারমা গানের প্রাণ চ থুই ফ্রু" height="600" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.%20january/04-01-2025/1_kaler-kantho--4-1-2025.jpg" width="1000" /></p> <p>সঙ্গীত পরিবেশন করছেন চ থুই ফ্রু মারমা।</p> <p><img alt="মারমা গানের প্রাণ চ থুই ফ্রু" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.%20january/04-01-2025/2_kaler-kantho--4-1-2025.jpg" /></p> <p>চ থুই ফ্রু মারমার অ্যালবাম।</p> <p><img alt="মারমা গানের প্রাণ চ থুই ফ্রু" height="600" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/11.%20january/04-01-2025/3_kaler-kantho--4-1-2025.jpg" width="1000" /></p> <p>মারমা শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্যোগে প্রকাশিত অ্যালবাম</p>