হবিগঞ্জ শহরটা খোয়াই নদীর তীরে। রয়েছে সুনাই, সুতাং, করাঙ্গী, ভেড়ামোহনা, শুঁটকি, রত্না, বিজনা, শাখা বরাক, কুশিয়ারা, মেঘনা, বিবিয়ানা ও কালনী নদীও। তেমনি ক্রীড়াঙ্গনে এক মোহনায় মিশে গেছে নানা দল ও মতের মানুষ। ক্রীড়া সংস্থায় প্রতিনিধিত্ব সবারই।
জেলার খেলা : হবিগঞ্জ
নতুন স্টেডিয়ামে নতুন স্বপ্ন
জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড় জোগাড়ের পাইপলাইনই হচ্ছে ছোট-

ফুটবলে অবশ্য আগের সেই জৌলুশ নেই।
ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমলে এই জনপদে জন্ম অনেক খ্যাতিমান খেলোয়াড়ের। ফুটবলে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল, মোহনবাগান আর মোহামেডান ক্লাবের প্রার্থিত ছিলেন এখানকার খেলোয়াড়রা। তবে আশির দশকে হবিগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলায় পরিণত হওয়ার পর অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে কমতে থাকে মাঠ। রিজার্ভ ট্যাংক পুকুরে একটা সময় সাঁতার হতো নিয়মিত। আদালতের এই জায়গার চারদিকে দেয়াল দেওয়ায় সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত এখন। তবে ঠেকানো গেছে পুকুরের ভরাট হওয়াটা। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে হারিয়ে গেছে বা যাওয়ার উপক্রম অধীর রায় মাঠ, পিটিআই, গরুহাটা, রজনী শাহ, স্টাফ কোয়ার্টার, উমেদ নগর মাদ্রাসা আর নিউফিল্ড মাঠ। তবে অবকাঠামোর উন্নয়ন করে ভালোভাবেই টুর্নামেন্ট আয়োজন করা যায় রিচি মাঠ, পইল মাঠ, শাজিবাজার পাহাড়ের মাঠ, চুনারুঘাট ডিসি স্কুল মাঠ ও চানপুর চা বাগান মাঠে। মাঠ আছে পুঁটিজুড়িতেও। এখানই গড়ে উঠেছে সাত তারকা হোটেল দ্য প্যালেস। সে সঙ্গে হবিগঞ্জে শিল্প স্থাপনা গড়ে তুলছে স্কয়ার ও প্রাণের মতো কম্পানিগুলো। তাতে পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ার সম্ভাবনায় স্বপ্ন দেখতেই পারে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ।
অন্ধকারের পর আলোর রেখার মতো নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে এখন। খেলাধুলায় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রবাসীদের এগিয়ে আসাটা এর অন্যতম। কিছু টুর্নামেন্টের পাশাপাশি কয়েকটা ক্লাবে সরাসরি আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করছেন প্রবাসীরা। হয়েছে হবিগঞ্জবাসীর বহু দিনের স্বপ্ন আধুনিক স্টেডিয়ামের বাস্তবায়নও। হবিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু জাহিরের প্রচেষ্টায় হবিগঞ্জবাসী পেয়েছে বহু কাঙ্ক্ষিত আধুনিক স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়াম হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনকে এক ধাপ এগিয়ে নিতেই পারে। স্টেডিয়ামটা অবশ্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয় এখনো। তবে এই পর্যায়ে আসতেও কেটে গেছে ৩৬ বছর!
১৯৭৮ সালে তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হবিগঞ্জে এসে মানসম্পন্ন স্টেডিয়ামের জন্য ঘোষণা দিয়েছিলেন ২০ লাখ টাকা দেওয়ার। এ জন্য একসময়ের ঘোড়দৌড় মাঠ হিসেবে পরিচিত নিউফিল্ডে স্টেডিয়াম নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। করা হয়েছিল মাটি ভরাটও। তবে হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় জমিটা নিজেদের দাবি করায় থমকে যায় নির্মাণ। এরপর ১৯৯৫ সালে ৩৩ লাখ টাকা খরচে সুলতান মাহমুদপুর গ্রামে ১১.৫০ একর জমিতে শুরু হয় আধুনিক স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ। সেখানেও বাধা হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের। জমির মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা ঠুকে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এরপর উচ্চ আদালতে আপিল করার পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ১৯৯৭ সালে কাটে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা। নতুন সমস্যা হয়ে আসে টাকার অভাব। অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আবু জাহিরের প্রচেষ্টায় দূর হয় সেটাও। তাই ১৭ কোটি টাকা খরচে আধুনিক স্টেডিয়াম স্বপ্নের জগৎ থেকে এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা।
আধুনিক স্টেডিয়াম হওয়ার পর জেলার ক্রীড়াঙ্গনে গতি ফেরাতে দরকার সংগঠকদের আন্তরিকতা। জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শাহাবউদ্দীন আহমেদের ছেলে অ্যাডভোকেট মনসুর উদ্দিন আহমেদ ইকবাল হয়তো অল্প কথাতেই বলে দিলেন অনেক কিছু, 'একটা সময় ফুটবলের জোয়ার দেখেছি হবিগঞ্জে। অথচ তখন টাকা ছিল না ক্লাবগুলোর হাতে। এখন অনেক ক্লাবেরই অঢেল টাকা। প্রবাসীরা নানাভাবে সাহায্য করেন তাদের। কিন্তু খেলায় চলছে ভাটার টান। এ জন্য দরকার সংগঠকদের উদ্যোগী হওয়া।' হবিগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গন একটা সময় নির্ভরশীল ছিল জালাল স্টেডিয়ামের ওপর। ১৯৫৬-৫৭ মৌসুমে তখনকার মহকুমা প্রশাসক জালালের নামে এই স্টেডিয়াম। পরে মফিজুর রহমান মহকুমা প্রশাসক হয়ে এসে নিজের নামে করতে চেয়েছিলেন স্টেডিয়ামটি। তবে ক্রীড়া সংগঠক শাহাবউদ্দীন আহমেদ মামলা করায় পিছু হটেন শেষ পর্যন্ত।
প্রবাসীদের পাঠানো টাকায় আর্থিক ভিত্তি সুদৃঢ় হয়েছে কয়েকটি ক্লাবের। পাশাপাশি আছে কিছু স্পন্সরও। ঢাকার বাইরে গ্রামীণফোন প্রথমবার স্পন্সর করে হবিগঞ্জ ক্রিকেট লিগে। সেটা ২০০৯ সালের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ। জেলার ক্রীড়াঙ্গনের অভিভাবক জেলা ক্রীড়া সংস্থাকে ধারাবাহিকভাবে সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র হবিগঞ্জ জেলা সমিতি। সাবেক ছাত্রনেতা জিয়া উদ্দিন বাবুলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আসে এই স্পন্সরশিপ। পাশাপাশি নিউ ইয়র্কে বসবাসরত হবিগঞ্জবাসীও একটি টুর্নামেন্ট স্পন্সর করে। অনেক লন্ডনপ্রবাসী জেলা ক্রীড়া সংস্থার বিভিন্ন দলকে স্পন্সরশিপ দিয়ে আসছেন অনেক দিন ধরে। এরপরও আগের মতো জাতীয় দলের খেলোয়াড়দের পদচারণ নেই হবিগঞ্জ ক্রিকেট লিগে। আমিনুল ইসলাম, খালেদ মাসুদ, আরাফাত সানি, নাসির হোসেনরা একটা সময় খেলেছেন এখানকার লিগে। খেলেছেন পাকিস্তানি জহুর এলাহি আর জাফর কোরেশির মতো ক্রিকেটার। মডার্ন ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটার বেনু গোপাল রাওয়েরও। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের সময় দেশে অস্থিশীলতা হওয়ার শঙ্কায় ভারত ফিরে যান তিনি।
ক্রিকেটে চারটা লিগ নিয়মিত হবিগঞ্জে। প্রিমিয়ার, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগের পাশাপাশি হয় টি-টোয়েন্টি লিগও। এই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট অনেক সময় হয়ে যায় জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপের মোড়কে। আশির দশকের শেষে হবিগঞ্জে শুরু হয় ক্রিকেট চর্চা। বিশেষ করে রুপালি কাপের মাধ্যমে শুরু ক্রিকেট বিপ্লবের। আছে মেয়েদের দলও। ফুটবলে জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজন করে কেবল প্রথম বিভাগ লিগ। সেটা হচ্ছে নিয়মিতই। ২৪ দল নিয়ে আয়োজিত প্রথম বিভাগের দল কমিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ লিগ আয়োজনের পরিকল্পনা আছে ডিএফএর। লিগের পাশাপাশি জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপও নিয়মিত এখানে। গত বছর আটটি উপজেলা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে আন্তউপজেলা টুর্নামেন্ট। স্পন্সর ছিল প্রাণ গ্রুপ। প্রাণকে নিয়েই এ বছর আরো পরিসরে হবে টুর্নামেন্টটা। উপজেলার বদলে এবার আটটি জেলা দল নিয়ে হতে যাচ্ছে জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দ্বন্দ্ব আছে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন আর জেলা ক্রীড়া সংস্থার। তবে হবিগঞ্জে সে সমস্যা নেই। দুই ফেডারেশনের কর্তাদের সম্প্রীতির জন্য মাঠ প্রাপ্তিতে ঝামেলা হয় না। সাফল্য আছে মেয়েদের ফুটবলেও। উচাইল আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েরা কয়েকবার হয়েছে বিভাগীয় চ্যাম্পিয়ন।
ভলিবল লিগ আলোর মুখ দেখেছে গত দুই বছর। এর আগে সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে হয়েছিল অল্প খরচের এ লিগ। খেলাটা মাঠে গড়ানোর সুফলও পেয়েছে হবিগঞ্জ। গত দুই বছর সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে তারা। জালাল স্টেডিয়ামে স্কোয়াশ কোর্ট রয়েছে একটি। তবে কোনো দিন খেলা গড়ায়নি সেই কোর্টে। তেমনি লন টেনিসের একটি কোর্ট থাকলেও সেখানে অপেশাদার ভাবে খেলেন অভিজাত পরিবারের মানুষরা। টেবিল টেনিস লিগও হয়নি গত বছর। তবে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প হয়েছে।
হবিগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বিতঙ্গল আখড়া, মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগান, শ্রীবাড়ি চা বাগান, চুনারুঘাটের রেমাকালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও নবীগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ড। তেমনি ক্রীড়াঙ্গনে দর্শনীয় ফুটবল ও ক্রিকেট জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপের ৫০ ভরির বেশি সোনা দিয়ে তৈরি শিরোপা দুটি। তবে ট্রফিগুলো কোনো দলকে না দিয়ে টুর্নামেন্ট শেষে দেওয়া হয় রেপ্লিকা। এই টুর্নামেন্টেও একটা সময় স্পন্সর করেছিল প্রাণ গ্রুপ। নিজেদের ক্রীড়াঙ্গনে প্রাণকে জড়িয়ে রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছেন সংগঠকরা। সমপ্রতি চালু হয়েছে এমপি আবু জাহির গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। এটিও সাড়া ফেলেছে ব্যাপক।
সম্পর্কিত খবর